ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রেমিট্যান্সে বাধা এক্সচেঞ্জ ফি!

রেমিট্যান্সে বাধা এক্সচেঞ্জ ফি!

প্রতিনিয়তই বাড়ছে ডলারের চাহিদা। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দাম। মান হারাচ্ছে দেশীয় মুদ্রা। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যাংকগুলোকে দেয়া হচ্ছে ডলার সহায়তা। এতে কমছে ডলার, বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এযাবৎকালের সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে দেশ। সদ্য শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৩ হাজার ৩২৪ কোটি ডলার। তবে সদ্য সমাপ্ত জুলাই মাসে রেকর্ড পরিমান প্রবাসী আয় এসেছে দেশে। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঈদকে সামনে রেখে প্রতিবছর বিপুল পরিমান রেমিট্যান্স আসে দেশে। তাই এতে স্বস্তির কিছু নেই। এখন আর সামনে ঈদ নেই। তাই রেমিট্যান্স কমার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে প্রবাসীরা বলছে, সরকার যদি কিছুটা সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দেয়, তাহলে রেমিট্যান্স আগের তুলনায় অনেকটা বেড়ে যাবে।

লক্ষ্মীপুরের আকাশ চন্দ্র পাল। তিনি এখন সিঙ্গাপুর প্রবাসী। এর আগে দুবাইতে ছিলেন। তার সাথে কথা হয় দৈনিক আনন্দবাজারের নিজস্ব প্রতিবেদক নাঈম কামালের। আকাশ বলেন, আমার সাথে কাজ করেন ১২ বাংলাদেশী প্রবাসী। এদের মধ্যে ১০ জনই দেশে টাকা পাঠায় হুন্ডির মাধ্যমে। আমরা দুইজন ব্যাংকে পাঠাই। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা আমাদেরকেও নানাভাবে প্রলোভন দেখায়। তারা বলে সরকার আপনাদের জন্য কি করছে? টাকা পাঠাবেন সেখান থেকেও ফি বাবদ ডলার কেটে রাখে। কিন্তু আমরা (হুন্ডি) তো কোনো ফি নিচ্ছি না বরং বাড়তি টাকা দিচ্ছি। এছাড়াও নানা ধরণের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে। মাঝে মাঝে মনে হয় হুন্ডিতেই টাকা পাঠাই। পরে দেশের কথা চিন্তা করে আর পাঠাই না।

হুন্ডিতে বেশি টাকা পাওয়া যায় জানিয়ে আকাশ চন্দ্র পাল বলেন, হুন্ডি ব্যবসায়ীরা যদি লাভ বেশি দিতে পারে ব্যাংকগুলো কেনো পারে না? প্রবাসীদেরকে আড়াই শতাংশ প্রনোদনা দেয়া হচ্ছে। একজন প্রবাসী দেশে ১০ হাজার টাকা পাঠালে প্রনোদনা পায় ২৫০ টাকা (ডলার ৯৪ টাকা হিসেবে)। কিন্তু এই ১০ হাজার টাকা পাঠাতে তাকে ফি বাবদ দিতে হয় ৪৭০ টাকা। তাহলে ব্যাংকগুলো আমাদের কাছ থেকে নিচ্ছে ৪৭০ টাকা আর দিচ্ছে ২৫০ টাকা। তাহলে একজন প্রবাসীর ২২০ টাকা বাড়তি যাচ্ছে। এতে করে প্রবাসীরা হুন্ডিতে টাকা পাঠাচ্ছে বেশি। যে কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ছে।

বাহরাইন প্রবাসী ফয়সাল রেজা বলেন, রেমিট্যান্স পাঠান এই আহবান সবাই করে। কিন্তু বিমানবন্দরে অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে দেখি না। একটা ট্রলি পর্যন্ত নিয়ে গাড়ি পর্যন্ত যাওয়া যায় না।

নোয়াখালীর জাবেদ হোসাইন। এই প্রবাসী নয় বছর ধরে থাকেন সৌদি আরবের জেদ্দা শহরে। জাবেদ বলেন, প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়। পরিশ্রমের টাকা দেশে পাঠাই। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে আমাদের টাকায়। এই নয় বছরে একবারো ব্যাংক ছাড়া টাকা পাঠাইনি। তবে আমার সাথে কাজ করা অনেকেই পাঠায়। আমার চেয়ে তাদের লাভ বেশি। তাদের খরচ দিতে হয় না। বরং বাড়তি টাকা পায়। অথচ ব্যাংক আমার কাছ থেকে ৫০০ টাকার মতো কেটে রাখে। যদিও আড়াই শতাংশ প্রনোদনা দেয়। আমার টাকায় আমাকে প্রনোদনার ব্যবস্থা করেছে সরকার। প্রনোদনা না দিয়ে চার্জ কাটা বন্ধ করা খুবই জরুরী।

ক্ষোভ প্রকাশ করে জাবেদ বলেন, পাসপোর্ট করা থেকে শুরু করে পুলিশ ভেরিফিকেশন, ভিসা প্রসেসিং, টিকিট, বিমানবন্দর কোথায় নেই হয়রানী। সবখানেই আমাদের সাথে ব্যবহার করা হয় পশুর মতো। বাড়তি টাকা না দিলে কোথাও সেবা মিলে না। বিমানবন্দরে ব্যাগ কেটে মূল্যবান জিনিসও নিয়ে যায় সেখানকার অনেকে। কিন্তু কেউ এ ব্যাপারে কিছুই বলে না। সরকারও কোনো পদক্ষেপ নেয় না। কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, একজন প্রবাসী যদি বিদেশে মারা যায়, সরকার তার দায়িত্ব নিতে চায় না। এ ব্যপারে কেউ সহায়তাও করে না। প্রবাসীর নিজের টাকায় দেশে মরদেহ নিয়ে যায়। এর থেকে বড় কষ্ট আর হতে পারে না। তাহলে প্রবাসীরা দেশের কথা কেনো ভাববে? তারা হুন্ডির বাড়তি লাভ বাদ দিয়ে কেনো ব্যাংকে টাকা পাঠাবে? এতো কিছুর পরও প্রবাসীরা ব্যাংকে টাকা পাঠায়। অনেকেই হয়তো পাঠায় না। তাদের অধিকাংশই আমাদেরকে বলে ব্যাংকে কেনো টাকা পাঠাই? সরকার কি আমাদের দিকে চায়? তখন আমারও ক্ষোভ হয়। হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে মন চায়। তবুও দেশকে ভালবেসে পাঠাই না। এমন গল্প আর দেশের নিয়মের প্রতি ক্ষোভ শুধু আকাশ, ফয়সাল আর জাবেদের না, এমন ক্ষোভ অসংখ্য বাংলাদেশী প্রবাসীর। তাদের প্রত্যেকেরই দাবি সরকার যেনো তাদের দিকে একটু সুনজর দেয়।

এসব প্রসঙ্গে একাধিক অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকারের এসব বিষয়ে নজর দেয়া উচিৎ। বিশেষ করে দেশের এই দুঃসময়ে প্রবাসীদের কথা একটু বেশি করে ভাবা প্রয়োজন। যেখানে তারা হয়রানীর শিকার হচ্ছে সেখানেই দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার। এক্সচেঞ্জ ফি মওকুফ করা দরকার বলেও মনে করছেন এই অর্থনীতিবিদরা।

অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. আইনুল ইসলাম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ডলার সংকট কাটাতে সরকার বিলাসী পন্যের আমদানি কমানোর পাশাপাশি রেমিট্যান্সে গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকারের এমন উদ্যেগ রিজার্ভের উপর চাপ কমাতে সহায়তা করবে। প্রবাসীদের আয় অনেকাংশে কমে গেছে জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এ কারণে রেমিট্যান্স অনেকটা কমে গেছে। এছাড়া এখনো অনেকেই হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। সরকারের আড়াই শতাংশ প্রনোদনায়ও আগ্রহ নেই অনেক প্রবাসীর। ব্যাংকে এক্সচেঞ্জ ফি বাবদ যে অর্থ কাটা হচ্ছে হুন্ডিতে কিন্তু তা কাটা হচ্ছে না। বরং হুন্ডিতে এ অর্থ না কেটেই প্রায় ৫ শতাংশ বাড়তি টাকা দেয়া হচ্ছে। আমার জানামতে এখন আর এ এক্সচেঞ্জ ফি কাটা হচ্ছে না। যদি নেয়া হয় তাহলে সরকারের উচিৎ এ ফি কমিয়ে আনা। আশা করছি সরকারের এ পদক্ষেপের প্রভাব পড়বে রেমিট্যান্সে। প্রবাসীরা টাকা পাঠাবে ব্যাংকে।

আইনুল ইসলাম বলেন, দেশের এই দুঃসময়ে যেখানে ব্যাংকগুলোকে পাশে দাঁড়ানোর কথা, সেখানে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। তারা এখন পুঁজিবাজারে টাকা ব্যয় না করে ডলার মজুদ করছে। অথচ তাদের এমন করার কথা না। ডলার তো ব্যবসা করার জন্য না। বাংলাদেশ ব্যাংক এই দায় এড়াতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং টিমের সক্ষমতা কম। তারা মনিটরিংয়ে সক্ষমতা বাড়াচ্ছে না। এদিকে কঠোর নজরদারি করতে হবে। তাহলে ডলারের অস্থিরতা কমে যাবে।

অর্থনীতিবিদ আবু আলম শাহিদ চৌধুরি দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ডলার সংকট কাটাতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ কমাতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ কোনো কাজে আসবে না। প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর চার্জ কমানো দরকার। প্রনোদনা দিচ্ছে ঠিক আছে কিন্তু পাঠানোর চার্জ কেটে নিচ্ছে। প্রবাসীদের কাছ থেকে এ চার্জ কাটা বন্ধ করলে প্রবাসীরা আরো উদ্ভুদ্ধ হবে। প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠালেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভালো থাকে। তারা টাকা কম পাঠালে রিজার্ভে চাপ পড়ে। বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানী বন্ধ করা দরকার জানিয়ে তিনি বলেন, ইন্টেলিজ্যান্ট টিমের সদস্য বাড়ানো উচিৎ। যাতে করে প্রবাসীরা হয়রানী না হয়, সেদিকে নজর দেয়া উচিৎ। প্রবাসীদের কাছে বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আপনারা নিজেদের সামান্য লাভের কথা চিন্তা না করে দেশের কথা, পরিবারের কথা ভেবে বৈধ পথে টাকা পাঠান। এতে দেশ ভালো থাকবে, অর্থনীতি ভালো থাকবে, সর্বোপরি আপনার পরিবার ভালো থাকবে।

প্রবাসীদের পাঠানো টাকার এক্সচেঞ্জ ফি কমানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মূখপাত্র সিরাজুল ইসলাম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, এক্সচেঞ্জ ফি খুব সামান্য নেয়া হচ্ছে। এই ফি প্রবাসীদের উপর খুব একটা প্রভাব পড়ার কথা না। তারা হয়তো হুন্ডিতে দুই থেকে চার টাকা পর্যন্ত বেশি পান। কিন্তু টাকাটা বৈধভাবে না আসার কারণে অবৈধ হয়ে যায়। কষ্ট করে বৈধ পথে আয় করা টাকা যদি দেশে এসে অবৈধ হয়ে যায় তাহলে তো পুরো কষ্টটাই বৃথা। তাছাড়া সরকার তো আড়াই শতাংশ প্রনোদনা দিচ্ছে। এছাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠালে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। চাইলে একজন প্রবাসী ব্যাংক থেকে লোন নিতে পারে। কিন্তু যারা হুন্ডিতে টাকা পাঠায় তারা তো এ সুযোগ পাচ্ছে না। তারপরও এ বিষয়টা নিয়ে আমরা চিন্তা-ভাবনা করে দেখবো।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, হুন্ডি আর অফিসিয়াল চ্যানেলে প্রায় সমান টাকা আসে। অফিসিয়াল চ্যানেলে আসে ৫১ শতাংশ আর হুন্ডিতে ৪৯ শতাংশ। অফিসিয়াল চ্যানেলে আনলে তো লস হচ্ছে না। প্রবাসীদের শুধু প্রণোদনা নয় স্বীকৃতিও দেওয়া হচ্ছে। তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মও কিন্তু এটি সুন্দরভাবে ভোগ করতে পারবে। এতে প্রশ্ন বা দায়বদ্ধ থাকবে না।

অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা সবসময় অফিসিয়াল চ্যানেলে বিদেশ থেকে টাকা আসুক সেটা প্রত্যাশা করি। কারণ এটার সুফল অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। হুন্ডির মাধ্যমে যদি টাকা নিয়ে আসেন সেটিকে অবৈধ বলব না, সেটি কালো টাকা। যারা সেই টাকা হুন্ডির মাধ্যমে নিয়ে আসেন, তারা সবসময় বিবেকের কাছে দায়ী থাকবেন।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন