ঢাকা | বুধবার
১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১লা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করযোগ্য নাগরিকের তথ্যে বিভ্রান্তি

করযোগ্য নাগরিকের তথ্যে বিভ্রান্তি

দেশে ই-টিআইএনধারীর সংখ্যা ৭০ লাখের মতো। কিন্তু রিটার্ন জমা দিচ্ছে প্রায় ২৫ লাখ। দুই-তৃত্বীংশ ই-টিআইএনধারী রিটার্ন দাখিলের বাইরে রয়েছে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে তাদের আয়করের অধীনে আনা খুবই জরুরি। গবেষণা বলছে, দেশে করযোগ্য নাগরিক অন্তত ২ কোটি রয়েছে। অনেকের মতে, ২ কোটিরও বেশি। করযোগ্য নাগরিকদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে এনবিআরের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন। একই সঙ্গে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল পদ্ধতিকে আরো জনপ্রিয় করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

গত মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নিজস্ব ভবনের সম্মেলন কক্ষে প্রাক বাজেট (২০২২-২৩ অর্থবছর) আলোচনায় ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) পক্ষে এসব কথা বলা হয়েছে। বৈঠকের সভাপত্বিত করেন এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। আলোচনায় ইআরএফ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনা পেশ করেন। আলোচনায় অংশগ্রহন করেন অর্থনীতি বিটের সাংবাদিকরা।

আয়করমুক্ত সীমা ৫ লাখ টাকা রাখার দাবি করে বাজেট প্রস্তাবনায় ইআরএফ সভাপতি শারমীন রিনভী জানান, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রপ্তানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে অনেক দেশের সঙ্গেই এফটিএ বা পিটিএর মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হবে। এ কারণে সরকারের রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব আসতে পারে। এক্ষেত্রে হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের শুল্ক আদায় তথা রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার ধাক্কা মোকাবিলায় এখন থেকেই প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করা দরকার।

দেশে ইটিআইনধারীর সংখ্যা ৭০ লাখের মতো জানিয়ে বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়, বর্তমানে আয়রক রিটার্ন দাখিল করছে প্রায় ২৫ লাখ। অথচ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব টিআইএনধারীর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। রিটার্ন দাখিল না করা এ বিপুল পরিমাণ টিআইএনধারীকে কর নেটের আওতায় আনতে আইনের বাধ্যবাধতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা দরকার। সিটি করপোরেশন এলাকার নাগরিকদের সর্বনিম্ন কর ৫ হাজার টাকা। করের এ পরিমাণটি কমিয়ে সব টিআইএনধারীকে কর প্রদানে উৎসাহী করার প্রস্তাব করা হয়।

দেশের অর্থনীতির পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত দশ বছরে বিপুল সংখ্যক মানুষ কর প্রদানে সামর্থ্যবান হয়েছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে, এই মুহূর্তে দেশে করযোগ্য মানুষ অন্তত ২ কোটি। আবার কেউ বলছেন এই সংখ্যা ২ কোটিরও বেশি। করযোগ্য নাগরিকদের সংখ্যা নিয়ে এই বিভ্রান্তি দূর করতে বা দেশে করযোগ্য প্রকৃত নাগরিকের সংখ্যা নিরুপণে এনবিআরের একটি ব্যাপকভিত্তিক জরিপ চালানো জরুরি। একইসঙ্গে তাদের করের আওতায় আনতে উপজেলা পর্যায়ে এনবিআরের কার্যক্রম বাড়ানো দরকার।

সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের দেয়া তথ্যমতে, দেশে ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি নাগরিক কাজ করেন। তবে এনবিআরে আয়কর জমা দেন মাত্র ১৪ থেকে ১৫ হাজার বিদেশি নাগরিক। দেশে কর্মরত বিদেশিরা বছরে ২৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যান বলে এক গবেষণায় জানিয়েছে টিআইবি। বিদেশি নাগরিকদের করের আওতায় আনতে এনবিআারের উদ্যোগ আরও জোরালো করা প্রয়োজন।

বর্তমান আইন অনুযায়ী কাঁচামাল বা পণ্য আমদানির সময় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উৎসে কর কাটা হয়। এটি পরবর্তীতে সমন্বয় করে এনবিআর। তবে পণ্য বিক্রি করে কর সমন্বয়ের আগ পর্যন্ত ব্যবসায়ীর বড় আকারের মূলধন আটকে যায়। প্রস্তাবে কর আদায়ের বিরোধিতা করা হয়। তবে এভাবে ব্যবসার মূলধন আটকিয়ে না রেখে অন্য কোনো বিকল্প পদ্ধতিতে কর আহরণ করা যায় কি না, তা ভাবতে এনবিআরকে পরামর্শ দেয়া হয়। একইসঙ্গে কোনো ব্যবসায়ী যেন কর ফাঁকি দিতে না পারেন সেজন্য এনবিআরের অটোমেশন ও কঠোর মনিটরিংয়ের সুপারিশ করা হয়।

অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল পদ্ধতিকে আরও জনপ্রিয় করতে ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণা চালানো দরকার বলে প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি এনবিআরের ওয়েব সাইটটি আপগ্রেড করার প্রস্তাব করা হয়। দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে, এই পাচার রোধে ২০১৩ সালে ট্রান্সফার প্রাইসিং নামে একটি আইন করা হয়েছিল। বাস্তবে এর অগ্রগতি কতটুকু সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। মুদ্রা পাচার রোধে ভারত অথবা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কঠোর আইন করা যায় কিনা সেটা ভেবে দেখার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। বিনিয়োগকারিদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কর কাঠামো প্রনয়ণ করা যেতে পারে। এটি হলে উদ্যোক্তারা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারবেন।

আয়কর নিয়ে আইনটি আধুনিক এবং সহজবোধ্য ভাষায় হলেও আইনটির খসড়া হওয়ার পরপরই দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার। প্রস্তাবনায় আইনটি বাস্তবায়নের আগে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বসে মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করার পরামর্শ দেয়া হয়।

কাঠামোগত সমস্যা বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পুর্নগঠন জরুরি। এক্ষেত্রে দুটি প্রস্তাব বিবেচনায় নেয়ার কথা বলা হয়। প্রথমত, ভারতের মতো ডাইরেক্ট ট্যাক্স এবং ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স নামে দুটি বিভাগ গঠন করা যায়। দুই বিভাগে দুইজন সচিব নিয়োগ করা যেতে পারে। অথবা একটি রেভিনিউ কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এর একজন প্রধান কমিশনার থাকবেন, যার অধীনে অন্য কমিশনাররা থাকবেন। সরকার তাদের নিয়োগ দেবে।

ভ্যাট ও শুল্ক প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে- বন্ডেড ওয়্যারহাউজ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে এনবিআর আইনি কাঠামোয় পরিবর্তনসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এ খাতে অনিয়ম রোধ এবং আরও রপ্তানিবান্ধব বন্ড ব্যবস্থাপনা তৈরির জন্য এনবিআরের নেয়া বন্ডেড ওয়্যারহাউজ অটোমেশন প্রকল্পের কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করে পুরো প্রক্রিয়াকে অটোমেশনের আওতায় আনা দরকার।

এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশনের সমন্বয়ে একটি ট্যারিফ কমিশন পলিসি করা হয়েছে। তবে ট্যারিফ নির্ধারণের ক্ষমতা শুধু এনবিআরের। কোন খাতের জন্য ট্যারিফ কেমন হবে, কীভাবে রেশনালাইজ করা উচিত তা আউট লাইন করা রয়েছে ওই পলিসিতে। স্থানীয় শিল্পের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কী কী সুবিধা দেয়া উচিত তা নির্ধারণ করে ট্যারিফ পলিসিটি দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়।

রপ্তানিতে তৈরি পোশাক শিল্পের অসামান্য সফলতার পেছনে এনবিআরের বন্ডেড সুবিধাসহ নানা ট্যারিফ সুবিধা রয়েছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্য সম্ভাবনাময় খাত যেন তৈরি পোশাক শিল্পের মতো নিয়মিত বন্ডেড সুবিধা পায় সে সুপারিশও করা হয়। একই এইচ এস কোড এ মাল্টিপল ট্যারিফ রয়েছে। এক ট্যারিফের পণ্য অন্য পণ্যের এইচ এস কোডে আমদানি করতে গেলে ব্যবসায়ীরা অনেকক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ করা হয়। অনেক সময় শুল্ক কর্তৃপক্ষের স্ক্যানিংয়ের ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি হয়। সুপারিশ হলো- প্রতিটি পণ্যের জন্যই আলাদা এইচ এইচ কোড নির্ধারণ করা।

ব্যবসায় পরিবেশ সহজ করা এবং এনবিআরের কার্যক্রমকে অটোমেশন করতে ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো করার উদ্যোগ রয়েছে এনবিআরের। ২০২২ সালে এটির উদ্বোধন হওয়ার কথা। এ কাজটি যেন নির্ধারিত সময়েই শেষ করে এনবিআর সে ব্যাপারে তাগিদ দেয়া হয়।

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, সারাদেশে খুচরা ব্যবসায়ীর সংখ্যা ২ মিলিয়নের বেশি। এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বড় অংশই কমপ্ল্যায়ন্ট নয়। স্বভাবতই তাদের বড় অংশ ভ্যাট দেয় না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভ্যাটের আওতায় আনার সুপারিশ করছি। পাশাপাশি খুচরা ব্যবসায়ীদের ভ্যাট, পণ্য মূল্যের ওপর নির্ধারণ না করে সংযোজিত মূল্যের ওপর নির্ধারণ করা দরকার। কারণ খুচরা ব্যবসায়ীরা ভ্যাট রিফান্ড পান না।

ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে ইএফডির ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উপর গুরুত্ব দেয়ার সুপারিশ করছি। পরিবেশবান্ধব বা সবুজ শিল্পায়নে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে এনবিআর সাধারন কারখানা ও পরিবেশবান্ধব শিল্পের মধ্যে কর্পোরেট করের ব্যবধান কমপক্ষে ৫ শতাংশ রাখা যেতে পারে। পরিবেশবান্ধব কারখানায় অতিরিক্ত বিনিয়োগের তুলনায় বিদ্যমান ২ শতাংশ কর সুবিধা অপ্রতুল। বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে বোতলজাত পানির উপর আরোপিত সম্পূরক শুল্ক শিথিল করা যায় কিনা সেটি ভেবে দেখা যেতে পারে।

জেলা শহরের বাইরে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উৎসাহ প্রদানে ওই বিনিয়োগকে করমুক্ত সুবিধা দেওয়া। সরকার রাজস্ব কাঠামোর পরিবর্তনে যেসব সিদ্ধান্ত নেয় (শুল্ককর কমানো বা বাড়ানো) তা পরবর্তীতে কী ধরণের প্রভাব ফেলে, তার একটি দক্ষ ও নির্মোহ বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। যাদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর ও শুল্ক ছাড়ের সুবিধা দেওয়া হয়, তারা যদি সুবিধা না পায়, সেক্ষেত্রে ওই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন সময় নিত্যপণ্যে করছাড় দেওয়া হলেও অভিযোগ রয়েছে, ভোক্তা পর্যায়ে তার সুফল যায় না সেটা দেখা দরকার।

এনবিআরের দেওয়া সুবিধার প্রকৃত ফল সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়নের লক্ষ্যে একটি দক্ষ ও শক্তিশালী বিভাগ তৈরির প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক বিষয়ক অনেক সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ী, ভোক্তা, করদাতা বা রাজস্বের উপর কী প্রভাব ফেলছে, তা বিশ্লেষণ করে পরবর্তীতে সংশোধনমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। ডিজিটাল অর্থনীতির যেহেতু দ্রুত বিকাশ ঘটছে, তাই এই খাতকে করের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন