ঢাকা | সোমবার
১৭ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৩রা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ওমিক্রমে কমেছে রপ্তানি

ওমিক্রমে কমেছে রপ্তানি

একদিকে করোনা মহামারির নতুন ধাক্কা ওমিক্রন, আরেকদিকে জ্বালানির দাম বাড়ার প্রভাবেও গড়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার ৬০ দশমিক ৬ শতাংশ পুনরুদ্ধার হয়েছে। আগে যা ছিল ৫৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ওমিক্রন সংক্রমণের প্রভাবে ৭১ শতাংশ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি বা বিক্রি কমেছে। আবার অতিরিক্ত স্বাস্থ্য-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি খরচও বেড়েছে ৭৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের। ৮২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, ওমিক্রনের জন্য সার্বিকভাবে পুঁজি ও শ্রমের খরচ বেড়েছে। রপ্তানি কমার ঝুঁকি বেড়েছে ৮৯ শতাংশের। ৯০ শতাংশ অতিরিক্ত স্বাস্থ্য-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ও ৯১ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে পুঁজি ও শ্রমের খরচ বাড়ার ঝুঁকি বেড়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষাপটে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) পরিচালিত এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘করোনার নতুন ধাক্কা: ব্যবসায় আস্থা কোন পথে’ শীর্ষক সপ্তম পর্যায়ের জরিপের ফলাফল গত সোমবার উপস্থাপন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।

দেশের ৮ বিভাগের ৩৮টি জেলার মোট ৫০২টি ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপটি করা হয়। জরিপে অন্তর্ভুক্ত ছিল উৎপাদন খাতের তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ঔষুধ প্রস্তুতকারক, হালকা প্রকৌশল ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো। সেবা খাতের ছিল পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন, আইসিটি ও টেলিকমিউনিকেশন, আর্থিক খাত ও রিয়েল এস্টেট।

চলতি ২০২২ সালের গত ৩ থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে উল্লেখিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত শীর্ষ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ফোনালাপের মাধ্যমে জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রতিষ্ঠানের মুনাফা, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, আয়, ব্যবসার খরচ এবং বিক্রি বা রপ্তানি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। উত্তর ০-১০০র একটি মানদণ্ডে পরিমাপ করা হয়েছে, যেখানে ০ মানে খুব খারাপ, ২৫ খারাপ, ৫০ কোনো পরিবর্তন নেই, ৭৫ ভালো এবং ১০০ খুব ভালো।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, করোনাকালে বাংলাদেশের শিল্প ও সেবাখাতের পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পেতে ২০২০ সালের জুলাই মাস থেকে সানেম ধারাবাহিকভাবে তিন মাস অন্তর অন্তর এ জরিপ পরিচালনা করছে। এবারের জরিপে, বাংলাদেশের সার্বিক ব্যবসা পরিস্থিতির ওপর জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি এবং ওমিক্রন ঢেউয়ের প্রভাব নিয়ে আলোকপাত করা হয়।

জরিপে দেখা যায়, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও ওমিক্রন সংক্রমণের ফলে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ডে নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে সার্বিকভাবে গত বছরের তুলনায় এবং তিন-মাস অন্তর পরিক্রমাতেও ব্যবসায় উন্নতি হয়েছে। কোভিডের নতুন ধাক্কার কারণে সামনের তিন মাসের জন্য ব্যবসাগুলোর প্রত্যাশা তুলনামূলক কম। অন্য দিকে সার্বিকভাবে ব্যবসার পরিবেশে উন্নতি হয়েছে। জরিপে দেখা যায়, পিবিএসআই (বার্ষিক) সূচকের মান ৫৬.৭৯ থেকে ৬০ এ উন্নীত হয়েছে। একইভাবে পিবিএসআই (ত্রৈমাসিক)-এও উন্নতি দেখা গেছে।

আগের বছরের তুলনায়, তৈরি পোশাক খাত, টেক্সটাইল, রেস্টুরেন্ট, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ঔষধ শিল্পের ব্যবসায় পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে। জানুয়ারি-মার্চ ২০২২ এর জন্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যাশা আগের চেয়ে কমেছে। সানেমের ব্যবসায় আস্থার সাতটি পর্যায়ের জরিপে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যাশা ও বাস্তব অবস্থার মধ্যে তুলনামূলক চিত্রও তুলে ধরা হয়। সপ্তম পর্যায়ের জরিপে ১৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার জোরদার হয়েছে। ষষ্ঠ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান ছিল ২১ শতাংশ। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার মোটামুটি বলে মনে করে ৪৪ শতাংশ আগে ছিল ৫২ শতাংশ।

জরিপকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭৪ শতাংশ কোনো প্রণোদনা প্যাকেজ পায়নি এবং মাত্র ২৩ শতাংশ পেয়েছে। প্রণোদনা পাওয়াদের মধ্যে ৪০ শতাংশের বক্তব্য ঐ প্যাকেজ যথেষ্ট নয়। ৬৫ শতাংশের বক্তব্য সরকারের পক্ষ থেকে আরও সাহায্য দরকার।

জরিপে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব বিষয়ে ৯৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে এতে যানবাহনের খরচ বেড়েছে এবং ৭৯ শতাংশের মতে উৎপাদন শক্তির খরচ বেড়েছে। আগের মতই এ পর্যায়ের জরিপেও ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, বন্ধক, দীর্ঘসূত্রিতা, ব্যাংক-মক্কেল সম্পর্ক ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমস্যার মুখোমুখি হয় বলে উঠে আসে।

জরিপের উত্তরের ওপর ভিত্তি করে সানেম তিনটি সূচকের মাধ্যমে তাদের গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করে। তারমধ্যে প্রেজেন্ট বিজনেস স্ট্যাটাস ইনডেক্স বা পিবিএসআই (বার্ষিক), প্রেজেন্ট বিজনেস স্ট্যাটাস ইনডেক্স বা পিবিএসআই (ত্রৈমাসিক) এবং বিজনেস কনফিডেন্স ইনডেক্স (পরবর্তী তিন মাস)। এর মধ্যে পিবিএসআই (বার্ষিক) এর মাধ্যমে ২০২১ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসের সাথে ২০২০ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসের ব্যবসার অবস্থার তুলনা করা হয়েছে।

পিবিএসআই (ত্রৈমাসিক) ২০২১ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসের সাথে ২০২১ সালের জুলাই- সেপ্টেম্বরের ব্যবসার অবস্থার তুলনা করা হয়েছে। অন্যদিকে বিজনেস কনফিডেন্স ইনডেক্স বা বিসিআই’র মাধ্যমে ২০২১ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসের তুলনায় প্রতিষ্ঠানগুলোর ২০২২ সালের জানুয়ারি-মার্চের প্রত্যাশাটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিটি সূচকই ০-১০০র মধ্যে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ৫০ এর বেশি অর্থ অবস্থার উন্নতি আর ৫০ এর নিচে অবস্থার অবনতি এবং ৫০ কোনো পরিবর্তন হয়নি।

জরিপে পাওয়া তথ্যাবলি থেকে ১০টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে ‘এনাবলিং বিজনেস ইনভাইরনমেন্ট ইনডেক্স (ইবিআই)’ তৈরি করা হয়েছে। সূচকগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ, পরিবহন, দক্ষ শ্রমশক্তি, সম্পত্তি নিবন্ধন, অর্থায়নের সুবিধা, কর ব্যবস্থা, লজিস্টিক্স, দুর্নীতি, সরকারি নীতি সহায়তা এবং করোনাভাইরাস মহামারির ব্যবস্থাপনা। এই ইন্ডেক্সটিরও মানদণ্ড ০ থেকে ১০০ এর মধ্যে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই ইন্ডেক্সের মান বাড়ার অর্থ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার পরিবেশ আগের তুলনায় ভালো ও কমার অর্থ ব্যবসার পরিবেশ আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে।

গত জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২১ এ সার্বিকভাবে ইবিআই সূচকে কিছুটা পতন হলেও, জরিপে এই সূচকে বর্তমানে উন্নতি হয়েছে। গত সাত পর্যায়ের জরিপে এই সূচকে সর্বোচ্চ মান দেখা গেছে অর্থাৎ ব্যবসার পরিবেশে গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উন্নতি হয়েছে। তবে, ইবিআই সূচকের কিছু কিছু উপাদান যেমন কর, দুর্নীতি, দক্ষ শ্রমশক্তি, যানবাহনের মান, বাণিজ্য কাঠামো এবং কোভিড ব্যবস্থাপনায় কিছু অবনতি দেখা যায়। এছাড়া চামড়া, পাইকারি এবং আবাসন খাতে ইবিআইয়ে কিছু অবনতি হয়েছে।

অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রণোদনা প্যাকেজের দ্রুত বিতরণ এবং প্রণোদনা প্যাকেজ পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজীকরণের ওপর জোর দেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়ন প্রাপ্তিতে এবং যোগান প্রবাহে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা প্রদানের কথাও বলেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক গৃহীত ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের প্রচার এবং ব্যাপক বাস্তবায়নের ওপরও জোর দেয়া হয়। অধ্যাপক রায়হান জ্বালানি তেল আমদানির ওপর কর কমানোর প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, জ্বালানির মূল্যের জন্য নীতিনির্ধারকদের একটি কৌশলগত, গতিশীল এবং ভবিষ্যৎ-মুখী নীতি গ্রহণ করা দরকার।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন