পোল্ট্রিশিল্পের ফিডের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি ও সিন্ডিকেটের কারণে লাভের মুখ তো দূরের কথা, ক্রমাগত লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রান্তিক খামারিদের। এভাবে চলতে থাকলে সম্ভাবনাময় পোল্ট্রিশিল্পখাত হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মাংস ও ডিম উৎপাদনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পোল্ট্রিখাতে মূলত মাংস উৎপাদনে ব্রয়লায় ও সোনালি মুরগি পালন করা হয়। ডিম উৎপাদনের জন্য পালন করা হয় লেয়ার মুরগি।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, জেলায় পোল্ট্রি খাতে ব্রয়লার খামার রয়েছে প্রায় ২৯০০টি। যার মধ্যে ৪০৯টি নিবন্ধিত। বাকি ২৫৬৮টি অনিবন্ধিত। লেয়ার খামারের সংখ্যা ৪০১৫টি। এর মধ্যে নিবন্ধিত ৬৩৪টি এবং অনিবন্ধিত ৩৩৮১টি। তবে মুরগির খাদ্য বিক্রেতা ও খামারিরা বলছেন, জেলায় খামারের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হবে। তারা আরো বলছেন, সোনালি মুরগির খামার নিবন্ধন শুরু না হওয়ায় জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগে নেই এর কোনো পরিসংখ্যান।
বেসরকারি হিসেবে জেলায় প্রায় দেড় হাজারের মতো সোনালি খামার রয়েছে। সব মিলিয়ে জেলাতে প্রায় সাড়ে ৮ হাজারের মতো খামার রয়েছে। এসব খামারে প্রায় ৫০ হাজার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। অথচ এই সম্ভাবনাময় খাতের প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা লাভের মুখ দেখছেন না। লাভের মূল অংশটা চলে যাচ্ছে মধ্যভোগীদের হাতে।
বিভিন্ন খামার ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে একটি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার দাম ৫০-৫৫ টাকা। প্রতি হাজার মুরগির পালনে খাবার লাগে প্রায় ৬০ বস্তা। যার বাজার মূল্য ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫শ’ টাকা। প্রতি হাজার মুরগির ঔষধ খরচ ১৪ হাজার টাকা। শীতের তীব্রতায় ঠান্ডাজনিত কারণে ঔষধ খরচ লাগছে প্রায় দ্বিগুণ। শীতে মুরগির ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে অন্যান্য সময়ের তুলনায় বিদ্যুতের খরচ হচ্ছে প্রায় পাঁচ গুন। এছাড়া ঠান্ডাজনিত রোগে মুরগির মৃত্যুহারও বেড়েছে। ফলে প্রতি কেজি মুরগির উৎপাদন খরচ পড়ছে ১১৮ থেকে ১২০টাকা। যা গ্রীষ্মের খরচের চেয়ে ২০/২৫ টাকা কেজি প্রতি বেশি। খামারে মুরগির মৃত্যু হার বেড়ে গেলে উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যায়। অথচ খামারিদের পাইকারি মুরগি বিক্রি করতে হচ্ছে ১২২ টাকা কেজি হিসেবে।
ব্রয়লার খামারি সোহাগ খান ও রাসেল মিয়া জানান, গতমাসে হঠাৎ ব্রয়লার মুরগির পাইকারি বাজার হয়েছিল ১৫০টাকা কেজি। বর্তমানে বাজার নেমে বিক্রি হচ্ছে ১২২ টাকায়। মুরগির বাচ্চার দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। শীতে রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। মৃত্যুহারও বেশি। ফলে ১২২ টাকা কেজি মুরগি বিক্রি করলে লাভ থাকছে না। খুরচা বিক্রি করতে পারলে খামারিরা কিছু লাভ পেতে পারেন।
সোনালি মুরগির খামার ঘুরে দেখা যায়, একটি সোনালি মুরগির বাচ্চার দাম ২৪ থেকে ২৮ টাকা। প্রতি হাজার মুরগির খাবার লাগে ৫৫ বস্তা। যার মূল্য প্রায় এক লাখ ৩৬ হাজার ১শ’ ২৫ টাকা। সোনালি মুরগি বিক্রির উপযোগি করতে সময় লাগে কমপক্ষে দুইমাস। কখনও কখনও আড়াইমাসও পার হয়ে যায়। সোনালিতে স্ট্রোকসহ নানা রোগে মৃত্যুর হারও বেশি। এছাড়া ৪/৫ শতাংশ বাচ্চা মারা যায় স্বাভাবিক মৃত্যুতে। ঔষধ খরচ আছে প্রায় ১৮ হাজার টাকা। দুই মাসে একটি মুরগির গড় ওজন হয় সাড়ে ৮শ’ গ্রাম। পাইকারি মূল্য কেজি প্রতি ১শ’ ৮০টাকা। এককেজি ওজনের একটি মুরগি উৎপাদন খরচ ১৮০ টাকার ওপরে।
খামারিরা কিছু মুরগি খুচরা বিক্রি করতে পারলে কিছুটা লাভ দেখেন। অন্যথায় সোনালি মুরগির খামারিদেরও লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। সোনালি মুরগির খামারি শাহীন আলম ও আব্দুর রশিদ জানান, সোনালী মুরগি উৎপাদন দীর্ঘ মেয়াদি। এই লম্ভা সময় মুরগি পালন করে বিনিয়োগ উঠছে না। সরাসরি ভোক্তাদের কাছে মুরগি বিক্রি করার সুযোগ হলে লাভ দেখা যেত।
এদিকে প্রতিটি লেয়ার মুরগির ডিম দেয়ার উপযুক্ত করতে খরচ পড়ে মুরগি প্রতি প্রায় ৪৫০ টাকা। ডিম দেয়া শেষে দুই কেজি ওজনের মুরগির বিক্রয় মূল্য পরে ৪শ’ টাকা। এখানেও মুরগি প্রতি লোকসান ৫০টাকা। ডিম দেয়া একটি মুরগি প্রতিদিন খাবার খায় ১১০ গ্রাম থেকে দেড়শ’ গ্রাম। প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ পড়ে প্রায় ৫ টাকা। খামারের ৮০ শতাংশ মুরগি ডিম দেয়ায় প্রতি ডিমে খরচ দাড়ায় সাড়ে ছয় টাকা। বর্তমানে ডিমের পাইকারি বিক্রয়মূল্য ৭শ থেকে সাড়ে সাতশত টাকা শতক। এতে লেয়ার খামারিরাও খুব একটা লাভের মুখ দেখছেন না।
টাঙ্গাইলের দীর্ঘদিনের লেয়ার খামারি আলমগীর হোসেন জানান, তিনি ২২ বছর যাবৎ লেয়ার মুরগি পালন করছেন। শুরুতে বচ্চার দাম ছিল ১০/১২ টাকা। বর্তমানে বাচ্চার দাম ৫০/৫৫ টাকা। খাবারের দাম ছিল ৬/৭শ টাকা বস্তা। যা বেড়ে বর্তমানে হয়েছে ২৪ থেকে ২৬শ টাকা। খাবারের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধিতে খামারিদের দুর্দিন যাচ্ছে। খাবারের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে ডিম বা মাংসের মূল্য বৃদ্ধি চারগুণ হওয়ার কথা। সে হারে ডিম বা মাংসের দাম না বাড়ায় খামারিরা লাভের মুখ দেখছেন না।
খামারিরা জানালেন, মুরগির বাচ্চা ক্রয় থেকে শুরু করে বিক্রি পর্যন্ত খামারিরা সিন্ডিকেটের কাচ্ছে জিম্মি। ছোট ছোট খামারিরা মুরগির বাচ্চা সরাসরি হ্যাচারি থেকে কিনতে পারেন না। এজন্য প্রতিটি মুরগির বাচ্চাতে ৪/৫ টাকা বেশি গুণতে হয় খামারিদের। প্রত্যন্ত অঞ্চলের খামারিদের আরও বেশি টাকা গুনতে হয়। অধিকাংশ খামারি জানেন না, মুরগির বাচ্চার বর্তমান হ্যাচারিতে বিক্রয়মূল্য কতো। কারণ খামারিরা মুরগির বাচ্চা ক্রয় করেন সাধারণত খাবারের ডিলার থেকে। খাবার বিক্রেতার ফিডের পাশাপাশি হ্যাচারি থেকে ভায়া হয়ে মুরগির বাচ্চা সরবরহ করেন। খাবারের দোকানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের কাছ থেকে ঔষধ নিয়ে থাকেন খামারিরা। অধিকাংশ ঔষধ বিক্রেতারা অতিরিক্ত ঔষধ দিয়ে থাকেন।
এদিকে খামারিদের উৎপাদিত মুরগি কয়েক হাত ঘুরে ভোক্তাদের হাতে যায়। খামারিদের কাছ থেকে টাকা না দিয়েই এসব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ফোনে মুরগি কিনে রাখেন। এতে প্রতি কেজি মুরগি খামারিদের বিক্রয় মূল্যের সঙ্গে ভোক্তাদের ক্রয়মূল্যে ৪০/৫০ টাকা পার্থক্য হয়। সোনালি মুরগির ক্ষেত্রে পার্থক্য আরও বেশি। খামারিদের কাছ থেকে ভোক্তারা সরাসরি মুরগি পেলে প্রতি কেজি মুরগিতে খামারিরা ২৫ থেকে ৩০ টাকা বেশি পাবেন। ভোক্তারাও ২০ থেকে ২৫ টাকা প্রতি কেজিতে কম পাবেন। এমনটাই জানালেন প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা।
এদিকে কিছু অসচ্ছল খামারি খাবারের ডিলারের সঙ্গে বাকিতে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মুরগি পালন করেন। সেক্ষেত্রে, বাচ্চা, খাদ্য ও ঔষধে বাড়তি মূল্য ধরা হয়। এতে লাভের বড় অংশ চলে যায় ওসব ডিলারদের হাতে। এছাড়া প্রথম শ্রেণির কোম্পানিগুলো নিজস্বভাবে মুরগি পালন ও নির্ধারিত লাভে খামারিদের দিয়ে মুরগি পালন শুরু করায় তাদের ওপর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন প্রান্তিক খামারিরা।
খাবার ব্যবসায়ী ইউসুফ জানান, গত দেড় বছরের মুরগির খাবারের দাম বেড়েছে বস্তা প্রতি সাড়ে পাঁচশ টাকা। খাবারের দামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মুরগির দাম বাড়লে ব্রয়লার মুরগির পাইকারি দাম হতো ১৮০টাকা কেজি। কিন্তু বর্তমান পাইকারি দাম ১২২টাকা। এতে অনেক খামারি ঝরে পড়ছেন।
খাবার ও ঔষধ বিক্রেতা মো. রুবেল হাসান জানান, গত কয়েক বছরে পোল্টি খাবারের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা লাভের মুখ দেখছেন না। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে ভর্তুকি দিয়ে হলেও ফিডের দাম হাতের নাগালে রাখা জরুরি।
টাঙ্গাইল জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. রানা মিয়া প্রান্তিক খামারিদের দুরাবস্থার কথা স্বীকার করে বলেন, খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় খামারিরা লাভের মুখ দেখছেন না। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে খাবারের দাম কমিয়ে আনা প্রয়োজন।
আনন্দবাজার/শহক