ঢাকা | মঙ্গলবার
৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গ্যাস সংকটে শিল্পখাত

গ্যাস সংকটে শিল্পখাত

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে দেশে ব্যাপক শিল্পায়নের ধারা তৈরি হয়েছে। শিল্পখাত সম্প্রসারণে সাশ্রয়ী জ্বালানি হিসেবে দিন দিন চাহিদা বাড়ছে প্রাকৃতি গ্যাসের। তবে চাহিদার তুলনায় জোগান তেমন বাড়ছে না। উল্টো গ্যাস সংকটের কারণে ব্যাপক চাপে পড়েছে শিল্পখাত। এতে বিপাকে পড়ছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। শিল্পায়নের পথে গ্যাস সংকটের চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রতিবেদক ইয়াহইয়া নকিবের তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন প্রথম পর্ব ‘গ্যাস সংকটে শিল্পখাত’।

গত এক দশকে দেশের অর্থনীতি বিশ্বমঞ্চে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। গড় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি থাকায় যা এশিয়ার নতুন অর্থনৈতিক ‘টাইগার’ হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে ৬০ ভাগ মানুষ কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে পূর্ণতা পাওয়া একদল উদ্যোক্তা শ্রেণি আর শ্রমসহজলভ্যতার সংমিশ্রণে দেশে ব্যাপক শিল্পায়ন ঘটছে। শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত করে দ্রুত সময়ে কর্মসংস্থান তৈরি করে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে সরকার ১০১টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে। আর এসব শিল্প-কারখানায় চালু করতে সাশ্রয়ী জ্বালানি হিসেবে দিন দিন চাহিদা বাড়ছে গ্যাসের। প্রতিনিয়ত ক্রমবর্ধমান এ চাহিদার তুলনায় গ্যাসের জোগান বাড়ছে না। উল্টো গ্যাস সংকটে চাপে পড়ছে শিল্পখাত আর চাপ বাড়ছে শিল্প উদ্যোক্তাদের।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ)র নেতারা সম্প্রতি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ, ৫-১০ বছর মেয়াদি জ্বালানি নীতি প্রণয়ন ও সব কারখানায় ইভিসি মিটার স্থাপনসহ কয়েকটি দাবি তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে নতুন করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সরকারি উদ্যোগে উদ্বেগ জানিয়েছেন তারা। শিল্প কারখানায় গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসই থেকে ৩ পিএসই হয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের। গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতি এরই মধ্যে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে অর্থনীতিবিদদেরও। তারা বলছেন, দেশের মোট ব্যবহৃত জ্বালানির প্রায় অর্ধেক প্রাকৃতিক গ্যাস। জ্বালানি পণ্যটির সংকট বেড়ে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হলে তা দেশের সার্বিক অর্থনীতিকেই চ্যালেঞ্জে ফেলে দিতে পারে।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত অর্থবছরে গ্যাসের দৈনিক গড় চাহিদা ছিল ৪৩০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে স্থানীয় উত্তোলন ও আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) মিলিয়ে সরবরাহ হয়েছে ৩০১ কোটি ঘনফুট। যার মধ্যে ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করে সরকার। হিসাব কষে দেখা যায়, সরবরাহ করা গ্যাসের তিন ভাগের এক ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এ বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানির কারণে গ্যাস খাতে ভর্তুকি বেড়েছে। সে হিসাবে চাহিদার বিপরীতে দৈনিক সরবরাহের ঘাটতি ছিল প্রায় ১৩০ কোটি ঘনফুটে। আমদানি করা এলএনজির সরবরাহ বাদ দিলে শুধু স্থানীয় সরবরাহ বিবেচনায় নিয়ে গত অর্থবছরে গ্যাসের দৈনিক সরবরাহে ঘাটতি ছিল প্রায় ১৮৮ কোটি ঘনফুট।

গ্যাসখাতে মাস্টারপ্ল্যান-২০১৭ ও পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান সমন্বয়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তথ্যমতে সামনে এ ঘাটতি আরো বাড়বে। ২০২৫ সাল নাগাদ তা বেড়ে ৩৯০ কোটি ঘনফুট হবে। ২০৩০ সালে এ ঘাটতি আরো বেড়ে দাঁড়াবে ৫৫৮ কোটি ঘনফুটে। গ্যাসের সরবরাহ সংকট মোকাবেলায় বর্তমানে এলএনজি আমদানিতে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির মূল্য পরিস্থিতি এরই মধ্যে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের শিল্প খাতের সম্প্রসারণ ঘটছে অনেকটা গ্যাসের ওপর নির্ভর করে। জ্বালানি পণ্যটির টেকসই সরবরাহ নিশ্চিত না করা গেলে সামনের দিনগুলোয় এ ধরনের বিড়ম্বনা আরো বড় হয়েও দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় দেশেই গ্যাসের অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি লাভজনক আমদানির পথও নিশ্চিত করা জরুরি।

বাংলাদেশ আগে নিজস্ব গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু ক্রমাগতভাবে গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়া ও চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। কিন্তু এলএনজি আমদানির খরচ জোগাতে ইতোমধ্যে পেট্রোবাংলাকে বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। অথচ দেশে উৎপাদিত গ্যাসের দাম পড়ে দুই থেকে তিন ডলার।

বর্তমানে এলএনজির বাজারে ঊর্ধ্বমুখিতা লাগামহীন হয়ে উঠছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থারমাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) এলএনজির দাম ছিল প্রায় ১৪ ডলারে। এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটসের তথ্য অনুযায়ী, এরপর পণ্যটির দাম কমে মার্চের শুরুতে নেমে আসে প্রতি এমএমবিটিইউ সাড়ে ৫ ডলারের কিছু বেশিতে। অক্টোবরে সরবরাহের জন্য বাংলাদেশের কাছে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজি ৩৫ ডলার করে চেয়েছিল আরো একটি প্রতিষ্ঠান। স্পট মার্কেট থেকে বাংলাদেশের ক্রয়মূল্য বিবেচনায় নিয়ে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালের ছয় মাসে পণ্যটির দাম বেড়েছে প্রায় ৪৩৭ শতাংশ।

জ্বালানি বিভাগের তথ্য বলছে, ২০২০ সালেও প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম পড়েছিল ৩ দশমিক ৮৩ ডলার। কিন্তু দাম ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকায় ২০২১ সালের শুরুতে পণ্যটি আমদানি বন্ধ রাখা হয়। স্পট মার্কেট থেকে কিনতে না পারায় জানুয়ারির মাঝামাঝি জাতীয় গ্যাস গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ অর্ধেকে নেমে আসে। দৈনিক ৮০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের বিপরীতে সেই সময় সরবরাহ কমে দাঁড়ায় ৩৯ কোটি ঘনফুট। এলএনজি সরবরাহ কমে যাওয়ায় সেই সময় দেশে অন্তত দুই হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়। শিল্প-কারখানায় গ্যাসের চাপ কমে যায়। ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চি) চাপে কারখানাগুলোর গ্যাস পাওয়ার কথা থাকলেও তা নেমে যায় ৩-৪ পিএসআই মাত্রায়। রেশনিং করে গ্যাস সরবরাহ করা হলেও হিমশিম খেতে থাকে বিতরণ কোম্পানিগুলো।

গেল বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট পাঁচ কার্গো এলএনজি কেনার পরিকল্পনা ছিল জ্বালানি বিভাগের। কিন্তু উচ্চমূল্য থাকায় জুলাইয়ে এক অনুশাসনের মাধ্যমে তা স্থগিত করা হয়। এরপর থেকে এতদিন এলএনজির আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ সংকট আরো বেড়েছে। বিপাকে পড়েছে বিদ্যুৎ খাত। উৎপাদন ঠিক রাখতে কখনো আবাসিক, আবার কখনো শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ কমানো হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে পরিবহন খাতেও। বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ বাড়াতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনার ভিত্তিতে বর্তমানে প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা করে সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখা হচ্ছে।

গেল বছরের ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগের মাসিক সমন্বয় সভায় জানানো হয়, সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের জন্য চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) ৭০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রয়োজন। এ ভর্তুকির বিপরীতে চলতি বছরের বাজেটে এখন পর্যন্ত বরাদ্দ রয়েছে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ রয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় দুই হাজার কোটি টাকা জ্বালানি বিভাগকে দিয়েছে। এলএনজি আমদানি করতে সরকারের এখনই দরকার ১৬০০ কোটি টাকা। কিন্তু এ বরাদ্দও যথেষ্ট নয় বলে মনে করছে জ্বালানি বিভাগ। এর আগে গত নভেম্বরে অর্থ বিভাগের কাছে ৯৩৩১ কোটি টাকার ভর্তুকি চেয়ে চিঠি দেয় তারা।

সরকারের জ্বালানি বিভাগ বলছে, বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় দৈনিক ৯৫০ এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করতে প্রয়োজন বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ-গ্যাস ও সারে বছরে ভর্তুকি লাগে ৭০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সরকার দিচ্ছে মাত্র সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৫৮ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি। এ অবস্থায় এলএনজি আমদানিতে বিপাকে পড়েছে জ্বালানি বিভাগ। ভর্তুকির ৫৮ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি মোকাবিলায় ইতোমধ্যে তারা বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তবে করোনার ধাক্কার মধ্যে আবার গ্যাসের দাম বাড়লে মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সহসাই এ সংকট থেকে উত্তরণের উপায় নেই বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ তামিম। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে কোনো ইমিডিয়েট সল্যুয়েশন নাই। এ পরিস্থিতি যে আসবে, তা অনেক আগে থেকেই জানা ছিল। এ ব্যাপারে অনেক আগে থেকেই বলা হয়েছে, ওয়ার্নিং দেয়া হয়েছে যে, গ্যাস সরবরাহ কমে যাবে। এখন আমাদের নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে হবে। খুলনায় এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন ল্যান্ডবেস হওয়ার কথা। সেটাও বহুদিন ধরে হচ্ছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে গ্যাসের ওপর চাপ কমাতে হবে। বর্তমানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত শেষ করলে গ্যাসের চাপ কমে আসবে।

উল্লেখ্য, গত বছরের জানুয়ারি আইএএএফসি প্রতিবেদনে ২০২১ এবং ২০২২ সালে বিশ্ব গ্যাসবাজারে মূল্যের উর্ধ্বগতির বিষয়ে আভাস দেয়া হয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে, এই মূল্যবৃদ্ধি ১০০ মার্কিন ডলার ছুঁয়ে যেতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে ক্রমাগত এলএনজি নির্ভর হতে থাকা বাংলাদেশ মহাসংকটে পড়তে পারে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন