ঢাকা | বৃহস্পতিবার
২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিল্পবিপ্লবে হুমকি ই-বর্জ্য

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের হাত ধরেই মূলত বিশ্বজুড়ে ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য প্রবল হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ই-বর্জ্য অন্যতম প্রধান বৈশ্বিক সংকটে পরিণত হয়েছে। যা সমাধান এখনই উদ্যোগ নেয়া না হলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় ই-বর্জ্যে জলবায়ুর পরিবর্তনকে ভয়াবহ করে তুলছে।

জাপানে অবস্থিত জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় গত ২০১৪ সালে বৈশ্বিক ই-বর্জ্যের প্রবাহ ও উৎস বিষয়ক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে বলা হয়, প্রতিবছর বিশ্বে চার কোটি টনেরও বেশি ই-বর্জ্য উৎপাদিত হয়। যার এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীন। এসব ই-বর্জ্যে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ

অনেক ধাতু ও অন্যান্য উপাদান রয়েছে। যেগুলি পুনঃচক্রায়ন করা সম্ভব। লোহা, তামা, সোনা, রূপা, অ্যালুমিনিয়াম, প্যালাডিয়াম ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য অন্যান্য উপাদানগুলির মোট মূল্য ৫২০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি।

জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদন মতে, ই-বর্জ্য শুধু উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠারই কারণ নয়। বরং মূল্যবান অনেক উপাদানের উৎসও। সে কারণে আধুনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশে গত এক দশকে প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকহারে বেড়েছে। এক হিসেবে তা ৩০ থেকে ৪০ গুণ। ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়া প্রযুক্তিপণ্যের অব্যবহৃত বা পরিত্যক্ত অংশ ফেলে দেয়া হচ্ছে যত্রতত্র। যা মাটির সঙ্গে মিশে পরিবেশের হুমকি সৃষ্টি করছে।

বেসরকারি সংস্থা এনভাইরনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশনের (ইএসডিও) গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর দেশে প্রায় ৪ লাখ টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। আগামী বছর (২০২৩) এই ই-বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ১২ লাখ টনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই এর ব্যবস্থাপনা করা না গেলে সামনের দিনে বড় ধরনের ঝুঁকির সৃষ্টি করবে। দুই-একটি ছোট প্রতিষ্ঠান কিছু ই-বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। তবে বড় পরিসরে এই উদ্যোগ নেওয়া না গেলে সংকট বাড়বে।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী প্রতিনিয়তই ছাড়িয়ে যাচ্ছে পরিবেশ দুষণের মাত্রা। দুষণ ঠেকাতে সোচ্চার হচ্ছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না পরিবেশ দুষণ।

দুষণ ঠেকাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে রাষ্ট্রগুলোকে। এমন পরিস্থিতিতে পরিবেশের জন্য নতুন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে ই-বর্জ্য। প্রতিনিয়তই বাড়ছে পরিত্যক্ত টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ক্যামেরা, এয়ারকন্ডিশনার, মাইক্রোওভেন, সিএফএল বাল্ব, ওয়াশিং মেশিন, মুঠোফোন, ডিভিডি প্লেয়ার, পানির ডিসপেন্সার, ওয়াটার পিউরিফায়ার, রেডিওথেরাপি মেশিন, এক্সরে, সিটি স্ক্যান, ড্রিল মেশিন, ইলেকট্রনিক খেলনাসামগ্রীর সংখ্যা। যা বিশ্ব কর্তাদের দ্রুত দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি, প্রতিদিন নতুন নতুন ভার্সনের উদ্ভাবন, নতুন পণ্যের বহুমুখী কার্যকারিতা, ধারণ ক্ষমতার বৃদ্ধি, আকর্ষণীয় ডিজাইন এবং আয়েশি জীবনের প্রতি মানুষের সহজাত আকর্ষণ ই-বর্জ্য সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়াও পুরনো ডিভাইসগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহারের মতো টেকসই না হওয়া, বাড়তি মেরামত খরচ এবং ক্ষেত্রবিশেষে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী বাজারজাতকরণ কৌশলের কারণেও ই-বর্জ্য সৃষ্টি হচ্ছে বলেও মনে করছেন তারা।

ই-বর্জ্য নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক জোট গ্লোবাল ই-ওয়েস্ট স্ট্যাটিসটিকস পার্টনারশিপের (জিইএসপি) এক হিসাবে দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি পাঁচ বছরে ২১ শতাংশ হারে ই-বর্জ্য বাড়ছে। ২০১৯ সালে বিশ্বে ই-বর্জ্য জমা হয়েছিলো ৫ হাজার ৩৬০ কোটি কেজি। যার পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সম্প্রতি ই-বর্জ্য ও শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সংস্থাটির হিসাবে, বিশ্বে ১ কোটি ২৯ লাখ নারী অপ্রাতিষ্ঠানিক বর্জ্য খাতে নিয়োজিত। এ সংখ্যক নারী ও তাদের অনাগত সন্তানদের বিষাক্ত ই-বর্জ্য দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। ই-বর্জ্য থেকে কার্যকর ও বাধ্যতামূলকভাবে এসব মা ও শিশুদের রক্ষার আহ্বান জানিয়ে সংস্থাটি বলছে, ই-বর্জ্যের অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদের রক্ষা করতে কার্যকর ও বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ জরুরি।

প্রতিবেদনে ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক তেদরোস আধানম গেব্রেয়াসুসকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, পৃথিবীজুড়ে ‘ই-বর্জ্যের সুনামি’ চলছে। মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়ছে। ই-বর্জ্যের ক্রমবর্ধমান হুমকি থেকে মূল্যবান সম্পদ ও শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করার আহবান জানানো হয়। সংস্থাটি আরও বলছে, অভিভাবকেরা প্রায়ই শিশুদের ই-বর্জ্য খেলতে দেন ও পুনর্ব্যবহার কাজে লাগান। ই-বর্জ্যের বিষাক্ত রাসায়নিক, বিশেষ করে মার্কারি এবং সিসা উচ্চমাত্রায় থাকে। এসব ক্ষতিকর পদার্থ খুব সহজেই শিশুর শরীরে প্রবেশ করে। এতে শিশুদের বুদ্ধি বিকাশের ক্ষমতা কমে।

বাংলাদেশে ই-বর্জ্যের সুনির্দিষ্ট কোনো হালনাগাদ পরিসংখ্যান নেই সরকারের কাছে। ২০১৮ সালে করা
পরিবেশ অধিদফতরের এক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, সে বছর দেশে বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক্স বর্জ্য জমা হয়েছিলো ৪ লাখ টন। এর মধ্যে কেবল ৩ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ বা রিসাইক্লিংশিল্পে ব্যবহার করা হয়েছে। বাকি ৯৭ শতাংশ মিশে গেছে পরিবেশে। প্রতিবেদননে বলা হয়, প্রতিবছর ই-বর্জ্য বাড়ছে ২০ শতাংশ হারে। ২০৩৫ সাল নাগাদ এই ই-বর্জ্য বছরে ৪৬ লাখ টনে দাঁড়াবে। ‘পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা’র (ইএসডিও) ২০১৮ সালে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য থেকে সৃষ্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে

একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বাংলাদেশে বছরে ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে ৩০ লাখ টন। এছাড়াও বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমপিআইএ) তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে দেশে ই-বর্জ্য তৈরি হয়েছিল ১ লাখ ৪২ হাজার টন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক জুন ২০১৯-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ, আর ডিসেম্বর ২০১৯-এ প্রকাশিত বিটিআরসি’র প্রতিবেদন বলছে দেশে বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৭২ হাজার। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতি বছর ২০-২৫ শতাংশ মোবাইলের ব্যবহারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। সেই হিসেবে দেশে শুধু মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের থেকেই একটা বিশাল পরিমাণ ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। যার আনুমানিক সংখ্যা হবে প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন ই-বর্জ্য।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-বর্জ্যৈ এক হাজারেরও বেশি বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত পদার্থ থাকে। নিত্যব্যবহার্য ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ বলেও জানান তারা। ইলেকট্রনিক সরঞ্জামে সিসা, পারদ, তামা, দস্তা, সিলিকন, সোনা, রূপা, নিকেল, প্যালাডিয়াম, ক্যাডমিয়াম, টিন, ক্রোমিয়াম, নাইট্রাস অক্সাইড,পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি), পলিক্লোরিনেটেড বাই ফিনাইল (পিসিবি) নামক রাসায়নিক থাকে। এসব রাসায়নিক মাটি ও পানিকে দূষিত করে ডেকে আনছে বিপদ। এসব রাসায়নিক নানাভাবে মানবদেহে প্রবেশ করে রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। টেলিভিশন ও কম্পিউটার মনিটরে থাকা সিসা,পারদ, কপার এবং মাদারবোর্ডে থাকা বেরিলিয়াম, সেলফোন, রেফ্রিজারেটর ও এসি’তে ব্যবহৃত ক্ষতিকর পদার্থ সমূহ ক্যান্সার ও কিডনি নষ্ট হওয়া, থাইরয়েড হরমোন বিপর্যস্ত করাসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে গর্ভবতী মা ও শিশুরা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ইফফাত আরা শামসাদ বলেন, ই-বর্জ্য গর্ভবতী মা ও শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ই-বর্জ্যের সিসা নবজাতকের স্নায়ুতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। অপরিণত শিশুর জন্ম, শিশুর ওজন কম হওয়া এবং মৃত শিশুর জন্ম দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। শিশু বড় হলে ফুসফুস, শ্বাসতন্ত্র, থাইরয়েড জটিলতা, ক্যানসার এবং হৃদ্‌রোগের মতো বড় রোগের জটিলতাও পড়ে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, দেশের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে কাজ করছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে ‘ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১’ প্রজ্ঞাপণ জারি করা হয়েছে।

অনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন