জবা ফুলের সমগোত্রীয় মেস্তা বা রোজেলার পরিচিত সরেল নামেও। এক ধরনের উপগুল্মজাতীয় উদ্ভিদের ফল মেস্তা গাঢ় রঙের টক স্বাদযুক্ত। এর আদিভূমি পশ্চিম আফ্রিকা বলে মনে করা হয়। পাটজাতীয় মেস্তা গাছের আঁশ থেকে এক সময় কাপড় তৈরির সুতা উৎপন্ন হতো। চাষ হতো পাটের বিকল্প হিসেবেও। অনেক অঞ্চলে মেস্তাশাক খাওয়া হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে এর ফুল পানিতে ফুটিয়ে পানীয় হিসেবে পান করা হয়। পরে অবশ্য এর ফুল, পাতা ও বীজের ঔষধি গুণের কারণে আরো বেশি জনপ্রিয় হয়।
বিশ্বের অনেক দেশেই মেস্তার বাণিজ্যিক চাষ হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেও পাওয়া যায় এই ফল। বলা যায়, দেশের সর্বত্রই জন্মে। তবে বাণিজ্যিকভাবে এখনও চাষ হয় না। তবে মেস্তা পাট থেকে তৈরি হচ্ছে আইসক্রিম, মেস্তাসত্ত্ব, চা, জ্যাম, জেলি, জুস, আচার ও পানীয়সহ হরেক রকমের খাদ্যপণ্য। বীজের (ফল) উপরের আবরণ বৃতি থেকে উৎপাদিত এসব খাদ্যপণ্য বাজারজাত করা গেলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে হাজার কোটি টাকা আয় হতে পারে।
সূত্রমতে, গবেষণার মাধ্যমে মেস্তাপাট থেকে বেশ কিছু খাদ্যপণ্য উৎপাদনের পদ্ধতি বের করেছে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিজেআরআই) রংপুর আঞ্চলিক কেন্দ্র। তবে বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে তেমন উদ্যোগ নেই। এ ব্যাপারে শিল্পোদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসছেন না। এ কারণে মেস্তা থেকে উৎপন্ন মূল্যবান এসব পণ্যের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এখনো গবেষণাগারেই আটকে রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, দেশে আঁশ উৎপাদনকারী তিন ধরণের ফসল উৎপাদন হয়। এর মধ্যে রয়েছে পাট, কেনাফ ও মেস্তা। আগেকার দিনে পাটজাতীয় ফসল মেস্তা গ্রামাঞ্চলে বাড়ির আশপাশে বা রাস্তার ধারে দেখা যেত। অধিকাংশ এলাকায় যাকে চুকুর বলা হয়। যা টক হিসেবে গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে তরকারিতে খাওয়া হতো। দেখতে সাধারণ হলেও এই উপগুল্মজাতীয় উদ্ভিদের গুণাগুণ অনেক। আফ্রিকাতে এর পাতা ও ফল থেকে উৎপাদিত পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার বেশ সমাদৃত। এর মধ্যে এইচএস-২৪ (কাটাযুক্ত) ও বিজেআরআই-৩ (কাঁটা ছাড়া) জাতের মেস্তা পাট শুধু আঁশের জন্য চাষ করা হয়। যদিও চরাঞ্চলসহ অনুর্বর জমিতে এর চাষ হয়, তবে তা বেশি নয়।
বিগত ২০১০ সালে মেস্তা খাবার উপযোগি সবজি মেস্তা-১ (চুকুর) নামে এর অবমুক্ত করে বিজেআরআই। শাক-সবজি কিংবা টক হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি রকমারী খাবার তৈরির ব্যাপারে গবেষণা চলছে। তবে এই জাত অবমুক্তের পর এখনও তা কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হয়নি। গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে স্বল্প পরিসরে চাষ ও গবেষণা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এজন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। এছাড়া উদ্যোক্তরা এগিয়ে এলে সম্ভাবনাময় এই মেস্তা পাট একদিন অর্থকরী ফসল হিসেবে কৃষকদের কাছে সমাদৃত হবে।
সূত্র আরো জানায়, প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ থেকে ৩০ শ্রাবণ পর্যস্ত এই মেস্তা বপন করা যায়। একটি মেস্তা গাছে ৪০ থেকে ৬০টি ফল ধরে। বৃতির (যা দিয়ে সুস্বাদু খাদ্যপণ্য তৈরি হয়) ফলন হয় প্রতি হেক্টর জমিতে দুই থেকে আড়াই টন। মেস্তা বেশ খরাসহিষ্ণু এবং পাটের তুলনায় কম উর্বর যেমন চরাঞ্চল ও পতিত জমিতে স্বল্প খরচে চাষ করা যায়। বন্য প্রজাতির মেস্তা (এম-৭১৫) থেকে বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন ও গবেষণার মাধ্যমে বিজেআরআই অধিক ফলনশীল সবজি হিসেবে খাবার উপযোগী উন্নত মেস্তার জাত উদ্ভাবন করেছে। এর কাণ্ড তামাটে রঙের আর শাখা-প্রশাখাবিশিষ্ট। কাণ্ড ও পাতায় কোনো কাঁটা থাকে না। পাতা আঙুল আকৃতির (খণ্ডিত), পাতার কিনারা ঢেউ খেলানো ও গাঢ় সবুজ। পরিণত অবস্থায় তামাটে লাল রঙ ধারণ করে, পাতার বৃন্ত ১০-১১ সেন্টিমিটার। ১৩০-১৪০ দিনে গাছে ফুল আসে।
ফুলের ব্যাস ৫-৭ মিলিমিটার, রঙ হলদে, গোড়ায় মেরুন দাগ রয়েছে। ফল অপ্রকৃত, ক্যাপসুল আকৃতির, ওপরের দিকে চোখা ও রোমমুক্ত এবং বৃতি পুরু ও মাংসালো। প্রতি হেক্টরে ৭ হাজার ৭৮৯ কেজি সবুজ পাতা এবং ২০০০-২০৫৫ কেজি বৃতি উৎপাদন হয়। বীজ গাঢ় বাদামি, রেমিফর্ম ও কিডনি আকারের। চুকুরের এক হাজার বীজের ওজন প্রায় ২০ গ্রাম। এর খৈল গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বীজ থেকে ২০ শতাংশ খাবার তেল উৎপাদন হয়। মেস্তার তেলে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ পালসিটিক অ্যাসিড, ৬ দশমিক ৮ শতাংশ স্টিয়ারিক অ্যাসিড, ৫১ শতাংশ অলিক অ্যাসিড ও ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ লিনোলিক অ্যাসিড থাকে। মেস্তার তেল পৃথিবীর অনেক দেশে সাবান তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এবং খাবার তেলে মেশানো হয়।
পৃথিবীর অনেক দেশেই মেস্তা খাদ্য হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। রংপুর ও রাজশাহীতে চুকাই, খুলনা ও সাতক্ষীরায় অম্লমধু, ধামরাই ও মানিকগঞ্জে চুকুল, সিলেটে হইলফা ও কুমিল্লায় মেডশ নামে এটি পরিচিত। এটিকে চাকমারা আমিলা, মগরা পুং ও ত্রিপুরারা উতমুখরই নামে চেনে। কোথাও কোথাও বলা হয় হুগ্নিমুখুই। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় এটিকে বলা হয় খড়গুলা। তবে সব শব্দের সরল বাংলা অর্থ টক। বর্তমানে পাট গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে স্বল্প পরিসরে মেস্তার চাষ হচ্ছে। এ থেকে তৈরি হচ্ছে চা, মেস্তাসত্ত্ব, জ্যাম, জেলি, জুস, আচার ইত্যাদি।
সম্প্রতি পাট গবেষণা কেন্দ্রে মেস্তা পাটের কর্তন শুরু হয়েছে। পাটের বীজের (ফল) উপরের আবরণ বৃতি ছড়িয়ে রোদে শুকাতে দেখা গেল নারী শ্রমিকদের। যা দিয়ে তৈরি হচ্ছে চাসহ হরেক রকম খাবার। অফিসে থরে থরে সাজানো রয়েছে এখানে তৈরি মেস্তাসত্ত্ব, জ্যাম, জেলি, জুস ও আচারের কন্টেইনার। যা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় আগত অতিথিদের।
রংপুর আঞ্চলিক পাট গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আবুল ফজল মোল্লা আনন্দবাজারকে বলেন, উপগুল্মজাতীয় এই উদ্ভিদের জনপ্রিয় নাম চুকুর। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে ফলটি পরিচিত। চুকুরপাতা রান্না করে তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। এর মাংসল বৃতি (শাঁস) থেকে নানা ধরনের খাবার তৈরি হয়। চুকুরের পাতা ও ফলে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, কেরোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-সি ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান রয়েছে। মেস্তার চা হৃদরোগীর জন্য উপকারী, রক্তের কোলেস্টেরলও নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া এর পাতায় রয়েছে ক্যানসার প্রতিষেধক উপাদান।
তবে এতগুণ থাকার পরও এর ব্যবহার শুধু গবেষণাগারেই আটকে আছে। রংপুর পাট গবষণা কেন্দ্র্রে চাসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য প্রস্তুত করে শুধু প্রদর্শনী ও অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে। ফসলটি বাজারজাত ও এর গুণাগুণ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পাট গবেষণা কেন্দ্র বিভিন্ন সভা-সেমিনার করেও শিল্পোদ্যোক্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছে না। এ ফসলটি নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না তারা। তবে আশার কথা ব্যক্ত করে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, গত বছর পাবনার কয়েকজন তরুণ বেশ কিছু জমিতে মেস্তার চাষ করে লাভবান হয়েছেন। এতে কৃষক পর্যায়ে এর জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে।
আনন্দবাজার/শহক