ওমিক্রনে রুদ্ধ করে রাখতে পারছে না বাণিজ্যের দ্বার। সব ভীতিকে পদদলিত করে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ^ অর্থনীতি। ঝুঁকি নিয়েই মানুষ এখন নেমে পড়েছে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে। ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকিতে প্রচণ্ড ভীতি ছিল মানুষের মনে। ২০২২ সালে সেটি পাল্টে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় যুক্ত হয়েছে।
যদিও এর মাঝে অনেক কিছুই গেছে পাল্টে। অর্থনীতির চাকা সামনে না গিয়ে মোচড় দিয়েছে পছনে। সেটি পুষাতে এখন ভয়কে জয় করে সামনে এগোচ্ছে বলে এক বিশ্লেষণে জানিয়েছে দ্য ইকোনমিস্ট।
এতে বলা হয়, ২০২১ সালের নভেম্বরে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর সবাই ঘাবড়ে গিয়েছিল। ধারণা ছিল অর্থনীতিতে আরো একটি ঝড় আসছে ধেয়ে। সেই ২০২০ সালের জায়গা ফিরে যাবে অর্থনীতি। তবে সেটি হয়নি। ২০২২ সালে ওমিক্রনকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে চাচ্ছে মানুষ। অবশ্য শুরুতে ওমিক্রন বৈশি^ক শেয়ার সূচকে কিছুটা ধাক্কা দিয়েছিল। পতন হয়েছিল ৫ শতাংশ। নিম্ন স্রোত আসে তেলের বাজারে।
জ¦ালানি তেলের দাম কমে ব্যারেলপ্রতি ১০ ডলার। তবে সেই ধাক্কা সামলে তেলের বাজারে আসে ভিন্ন স্রোত। ১৮ জানুয়ারি জ্বালানি তেলের দাম সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮৮ ডলারে উঠে যায়।
দ্য ইকোনমিস্ট জানায়, বর্তমানে বৈশ্বিক শেয়ারবাজারের অবস্থা নড়বড়ে। এটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে-কোভিড-১৯-এর জন্যে নয়।
মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস ইউরোপের বিমান পরিবহন কোম্পানি ও হোটেলের শেয়ারমূল্য সূচক তৈরি করেছে। এতে দেখা গেছে, এসব ব্যবসার ভবিষ্যৎ বেশ ভালো। অর্থাৎ করোনাভাইরাস বৃদ্ধি সত্ত্বেও মানুষ এখন তেমন পাত্তা দিচ্ছে না।
তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছেন ধনী দেশগুলোর জোট ওইসিডির বিশ্লেষক নিকোলাস উলেসজকো। তিনি মূলত ৪৬টি মধ্যম ও উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের মানুষের গুগল সার্চের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। গৃহায়ণ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা-এসব বিষয়ের তথ্য নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তিনি। এ সূচকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, এই ৪৬টি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার এখন প্রাক-মহামারি যুগের চেয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ ছোট। নভেম্বর মাসের চেয়ে তা কিছুটা কম, তবে এক বছর আগের, অর্থাৎ ২০২১ সালের জানুয়ারির তুলনায় তা বেশ ভালো, তখন জিডিপি প্রাক-মহামারি সময়ের তুলনায় ৫ শতাংশ কম ছিল।
বার ওমিক্রনের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির অতটা ক্ষতি কেন হলো না, কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি দিলেই তা পরিষ্কার হবে। বিষয়টি হলো, এবারের তৃতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ও মৃত্যুর হার অত বেশি নয়। চীন ছাড়া খুব কমসংখ্যক দেশই মনে করছে, মানুষের চলাফেরায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চীনের এই শূন্য কোভিড নীতির সমালোচনা করেছে। নেদারল্যান্ডস প্রকৃত অর্থে লকডাউন আরোপ করে, যদিও ১৪ জানুয়ারি তারা আংশিকভাবে তা তুলে নেয়। আন্তর্জাতিক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা অক্টোবরের পর সেভাবে বাড়েনি।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর ব্রিটেন জানায়, দুই ডোজ টিকা নেওয়ার সনদ থাকলে ভ্রমণকারীদের করোনা পরীক্ষা করানোরও প্রয়োজন নেই। থাইল্যান্ডও পর্যটক টানতে বিধিনিষেধ শিথিল করেছে। সবচেয়ে আশার কথা হলো, মানুষ এখন ঝুঁকি নিতে আগ্রহী। বিষয়টি এখন অনেকটা এরকম হয়ে গেছে: ২০২০ সংক্রমণ নিয়ে প্রচণ্ড ভীতি, ২০২১ অল্প ভীতি, ২০২২ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। মানুষের এই অদম্য মনোভাবের কল্যাণে বিশ্ব অর্থনীতি দ্রুতই স্বাভাবিক হবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। প্রাণের বিনিময়ে ক্ষতি মেনে নিতে অনেকটাই প্রস্তুত মানুষ।
গোল্ডম্যান স্যাকস যে লকডাউন সূচক প্রণয়ন করেছে, তাতে দেখা যায়, ডেলটা ধরনের চেয়ে এবার ওমিক্রন ধরনের প্রভাবে অনেক দেশে দ্বিগুণ-তিন গুণ সংক্রমণ হলেও বিধিনিষেধের মাত্রা বাড়ানো হয়নি। গত বছর জুলাই-আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে দৈনিক সংক্রমণ ছিল ১০০-এর অনেক কম। এখন সেখানে দিনে দুই হাজারের বেশি সংক্রমণ হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এ শহরের ব্যায়ামাগার ও রেস্তোরাঁ হয়নি বন্ধ।
তবে ওমিক্রনে এত বেশি মানুষ আক্রান্ত হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে ভিন্ন ধরনের প্রভাব পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোর জরিপ অনুসারে, জানুয়ারির শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৮৮ লাখ মানুষ আক্রান্ত মানুষের সেবা করতে গিয়ে বা নিজেরা আক্রান্ত হয়ে কাজের বাইরে ছিলেন। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের অনেক দেশেই শ্রমিকসংকট সৃষ্টি হয়েছে। অনেক দোকানমালিক কর্মীর অভাবে পুরো সময় দোকান চালাতে পারছেন না। আরেক বিনিয়োগ ব্যাংক জে পি মরগ্যানের হিসাব অনুসারে, এই শ্রমিকসংকটের কারণে জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশ জিডিপি শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে।
এদিকে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহরে আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও ধারণা করছে, এই ঢেউ মার্চ নাগাদ থেমে যাবে।বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপেও দেখা গেছে, কোম্পানিগুলোর আত্মবিশ্বাসে তেমন চিড় ধরেনি। সব মিলিয়ে তাই বিশ্লেষকেরা আশা করছেন, অমিক্রনের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির বিশেষ ক্ষতি হবে না।
আনন্দবাজার/শহক