হানিফ, ফরহাদ, জসিম, সুজিৎ, নীলকমল, সাইফুল, লাল মিয়া শাড়ি বুঁনছেন। টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীর বেশ কিছু তাঁতঘর ঘুরে ওদের মতো বেশ কিছু শিল্পিকে শাড়ি বানাতে দেখা গেল। চোখে-মুখে ওদের আতঙ্কের ছাপ। কখন বুঝি বন্ধ হয়ে যায় কাজ। এসব তাঁতীর এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে ২০২০-২১ সালে করোনায় লকডাউনের সময় থেকে। ওই সময়ে তাঁতপল্লীর অর্ধেক তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁতীরা চলে গেছেন অন্য পেশায়। কেউ কেউ এখন প্রবাসী। যারা শিল্পটাকে ধরে রেখেছেন তারাও ঋণের বোঝায় ন্যুজ হয়ে পড়েছেন।
লকডাউনের পর সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছিল যখন তখন তাঁত শ্রমিক-মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল মাত্র। অনেকটা স্বাভাবিকও হয়েছিল। এর মধ্যে আবার ওমিক্রনের ধাক্কায় তৃতীয় দফায় তাঁতশিল্প পড়তে যাচ্ছে ফের হুমকিতে। এমন আশঙ্কার কথাই জানালেন শিল্পে জড়িতরা। বেশ কয়েকটি উপজেলায় তাঁত থাকলেও তাঁতপল্লী মূলত ভাবা হয় টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার চন্ডি-পাথরাইলসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাকে। এখানকার বেশিরভাগের প্রধান পেশা শাড়ি বানানো। এছাড়া, সুঁতা গোছানো, বুটিকাট ও শাড়ি বিক্রিসহ নানা কাজে পরিবারের নারী-শিশুরাও সম্পৃক্ত।
আসছে ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে তাঁতপল্লী এখন অনেকটাই মুখরিত। অথচ ওমিক্রনের কারণে ফের নীরবতা নেমে এসেছে। এভাবে চলতে থাকলে ঈদের শাড়ি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বড় আকারের ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হবেন তাঁতীরা। তাঁত শিল্পি, শাড়ি ব্যবসায়িসহ শাড়ি বানানোর কাজে জড়িত সবাই বেকার হয়ে পড়বেন।
করোনা মহামারির ওপর আবার ২০২০ সালের বন্যা জেলার তাঁতশিল্পকে আরেক ধাপ পিছিয়ে দিয়েছে, ক্ষতবিক্ষত করেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানায় মালিকদের বিনিয়োগ বিনষ্ট হচ্ছিল। বন্যার পানি প্রবেশ করে কারখানায় চালু তাঁত, তাঁতে থাকা সুঁতার ভিম, কাপড় ও সরঞ্জামাদি প্রায় সবই নষ্ট হয়। এরপরও তাঁতশিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গেল বছরের রমজানের আগে থেকে কিছু কিছু তাঁত খুলতে শুরু হয়। এরই মধ্যে সুঁতা, রঙ, রাসায়নিক কেমিকেল ও তাঁতের অন্যান্য সরঞ্জামাদির দামও বেড়ে যায়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে সেখানেও ধাক্কা দেয়। এবার রমজানের আগে ওমিক্রনের ধাক্কায় তাঁত শিল্প চরম হুমকির মুখে পড়ছে।
হানিফের মতো শিল্পিরা জানান, গত লকডাউনে এ অঞ্চলের তাঁত শিল্পিরা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে চলছিলেন। তবে এবারের ওমিক্রনে অনেক শ্রমিক তাঁতঘরে আসছেন না। তারা বলেন, আমরা কোনো রকম কাজ করছি। আমাদের সংসার চললেও যারা আসছে না তারা আরও ঋণি হয়ে পড়বে।
করোনাকালে তাঁতপল্লীর জগন্নাথ রাজবংশী, শচীন রাজবংশী, গুপিনাথ রাজবংশী ও দমন রাজবংশীরা একদিকে ছিলেন প্রতিষ্ঠিত, অন্যদিকে ছিলেন বড় ব্যবসায়ী। করোনার ধাক্কায় ছিটকে পড়েছেন তারা। তাদের মতোই ছিটকে পড়েছেন আরো অসংখ্য তাঁতী। শাড়ি ব্যবসা একটি গোষ্ঠির হাতে চলে যাওয়ায় সেই দাপটে ব্যবসায়ীদের দিন কাটছে এখন অর্ধহারে-অনাহারে। ওই সময় জগন্নাথ রাজবংশীর ৫২টি তাঁত ছিল। শচীনের ২০টি, গুপিনাথের ছিল ১০টি আর দমনের ছিল ২০টি তাঁত। ওরা অন্যান্য তাঁতীদের পত্তন দিতেন। শাড়ির নতুনত্ব এরাই আগে আনতেন। তাঁতী আর বড় ব্যবসায়ী হিসেবে একটা পরিচিতি ছিল। অর্থনৈতিক দিক দিয়েও সমাজে একটা অবস্থান ছিল। অথচ এসব দাপটে শাড়ি ব্যবসায়ীরা তাদের পেশা ধরে রাখতে পারেননি।
আলী হোসেন নামের এক তাঁত শিল্পী জানালেন, গত লকডাউনে তিনি ৫৫ হাজার টাকা এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। তখন কিস্তি না নিলেও লকডাউন শিথিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিস্তি শুরু হয়। বর্তমানে তাকে সপ্তাহে ১৫ হাজার টাকা কিস্তি গুনতে হচ্ছে। এখন শাড়ির বাজার কমে যাচ্ছে। মহাজনরা উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। আবার লকডাউনের কবলে পড়লে আমার মতো অনেকেই আর ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। তখন অন্য পেশায় চলে যেতে হবে।
টাঙ্গাইলে করটিয়াতে রয়েছে দেশের অন্যতম টাঙ্গাইল শাড়ির পাইকারী হাট। মঙ্গল-বুধবার এ হাটে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা শাড়ি কিনতে আসেন। ওমিক্রনের প্রভাবে গত হাটে তেমন কোনো পাইকার আসেননি শাড়ি কিনতে। ফলে কোটি-কোটি টাকা বিক্রির শাড়ি হাটে পাইকারি বিক্রি হয়নি টাঙ্গাইল শাড়ি। করটিয়া হাটের পাইকারি শাড়ি বিক্রেতা নিতাই বসাক, মনোরঞ্জন বসাক, উজ্জল বসাক, খুশি বসাক, ইমান আলীসহ অধিকাংশ পাইকারী ব্যবসায়ীরা করটিয়া হাটের শাড়ি বিক্রি সম্পর্কে এমটি জানালেন। তাঁতপল্লীর অধিকাংশ শাড়ির শো-রুম ঘুরে দেখা গেল কোনো প্রকার ক্রেতা নেই তাদের বিক্রয় কেন্দ্রে। হঠাৎ শাড়ি বিক্রি কমে যাওয়ার বিষয়েও তারা জানালেন ওমিক্রন আতঙ্কের কথা।
তাঁতশিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য জেলার কালিহাতীর বল্লায় (ঘাটাইল, মধুপুর, ধনবাড়ী, গোপালপুর, কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলার জন্য একটি এবং সদর উপজেলার বাজিতপুর, দেলদুয়ার, বাসাইল, মির্জাপুর, নাগরপুর, সখীপুর ও সদর উপজেলার জন্য একটি) বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের দুইটি বেসিক সেন্টার রয়েছে। বাতাঁবো’র বাজিতপুর ও বল্লায় এ দুইটি বেসিক সেন্টারের নিয়ন্ত্রণে ৪৯টি প্রাথমিক তাঁতী সমিতি এবং ৪টি মাধ্যমিক তাঁতী সমিতি রয়েছে। এসব সমিতির চার হাজার ৩৯১টি তাঁত ফ্যাক্টরি মালিকের ৩০ হাজারের উপরে তাঁত রয়েছে। এ পেশায় এক লাখ তিন হাজারেরও বেশি তাঁত শ্রমিক সম্পৃক্ত। এরা সবাই এ শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তবে কেউ কেউ অনলাইনে কিছু শাড়ি বিক্রি কওে তাদের নিজস্ব ব্যবসাকে নামেমাত্র টিকিয়ে রেখেছেন।
এ অঞ্চলের শাড়ি ব্যবসায়ী সোরহাব হোসেন জানান, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির মূল ব্যবসা ঈদ-পঁজাকে কেন্দ্র করে। সারাবছর ব্যবসাটাকে ধরে রাখা হয়। ঈদ বা পুঁজাকে ঘিরে সারাবছরের উৎপাদিত শাড়ি বিক্রি শেষ হয়। সামনেই রমজান। ঈদের শাড়ি প্রস্তুতের সময় যাচ্ছে। কিন্তু করোনা বা ওমিক্রনের আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পাইকারি শাড়ি বিক্রি কমে গেছে। শাড়ি বিক্রি কমে গেলে উৎপাদনও কমে যায়। উৎপাদনের পরিমাণ কমে গেলে তাঁত শিল্পিরা বিপাকে পড়ে। এভাবে চলতে থাকলে এ শিল্প আবারও হুমকির মুখে পড়বে।
টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীর শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, করোনার প্রথম ঢেউয়ের পর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা কাপড় কিনতে আসা শুরু করেছিল। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আবার থেমে যায়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ঈদুল ফিতরের কয়েকদিন আগে সীমিত পরিসরে তাঁত চালু হয়েছিল। কিন্তু ক্রেতা ছিল সীমিত। এরপরও ধীরে ধীরে তাঁতীরা স্বাভাবিক হচ্ছিল। দেশে হঠাৎ করোনা বা ওমিক্রনে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া কয়েক দিনে তাঁত শিল্পে ধস নেমেছে।
আনন্দবাজার/শহক