ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চাষিদের চোখে সর্ষে ফুল

চাষিদের চোখে সর্ষে ফুল

ফুলের রাজ্য হিসেবে পরিচিত যশোরের গদখালীর ফুল চাষিদের একের পর এক বিপদ লেগেই আছে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও অতিমারি করোনায় তারা গত দুই বছর ফুল বেচাকেনা করতে না পেরে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে গত কয়েক মাস ধরে পরিশ্রম করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার মুখে এবার বাধা হয়েছে করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন। অতি দ্রুত সংক্রমণ ঘটানোর কারণে ইতোমধ্যে সব ধরনের সমাবেশ ও সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। ফলে ফুল বেচাকেনা কমে ১০ ভাগে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় চোখে সর্ষের ফুল দেখছেন গদখালীর ফুল চাষিরা।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি-পানিসারাসহ আশপাশের এলাকায় এক হাজার একর জমিতে বছরজুড়ে উৎপাদন হয় দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুল। গ্রামের পথ ধরে এগোলে গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্ল্যাডিওলাস, গাঁদা, জারবেরা ফুলের সুভাসে জুড়িয়ে যায় প্রাণ। কিন্তু একের পর এক দুর্যোগ ও অতিমারি করোনার ঢেউ যেন কৃষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। উৎপাদিত ফুল বিক্রি করতে না পেরে তারা চোখে সর্ষের ফুল দেখছেন। আসছে পয়লা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও মহান শহীদ দিবস এবং স্বাধীনতা দিবসের আগ মুহূর্তে পর্যন্ত ফুলগুলো বিক্রি করতে কর্মব্যস্ততা থাকলেও তাদের মুখে হাসি নেই। লকডাউন আতংক বিরাজ করছে ফুল চাষিদের মাঝে।

এমন সব দুঃশ্চিন্তার কথা বলছিলেন গদখালি এলাকার নীলকণ্ঠ গ্রামের শফিকুল ইসলাম। বলছিলেন মাস চারেক পরিচর্যায় বর্তমানে দেড় বিঘা জমিতে গোলাপ, ১২ কাটা জমিতে জারবেরা ও দেড় বিঘা জমিতে গাঁদা ফুলে ফুলে ভরে গেছে ক্ষেত। কিন্তু করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন চিন্তার ভাজ ফেলেছে। করোনার বিধিনিষেধে ইতোমধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক সভা সমাবেশ; এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় বিক্রি কমে শতকরা ১০ ভাগে নেমেছে। আর দাম কমেছে অর্ধেক।

Exif_JPEG_420

পানিসারার হাঁড়িয়াদাড়া এলাকার ফুল চাষি সাঈদ আলী জানান, ২০ হাজার টাকা খরচ করে দেড় বিঘা জমিতে গাঁধা ফুল চাষ করেছি। ডিসেম্বর পর্যন্ত ভালো দাম ছিলো, তবে জানুয়ারি থেকে করোনা বাড়ায় অনুষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে। সেই সাথে আমাদের ফুল বেঁচা-কেনায় দাম ধস নেমেছে।

পানিসারা এলাকার ফুল চাষী ইসমাইল জানান, গেল দুই বছর লকডাউনের কারণে ফুল বেচতে না পেরে নিঃস্ব হতে বসেছিলাম। কেউ আবার ফুলের আবাদ ছেড়ে অন্য ফসলের আবাদ শুরু করেছে। করোনার প্রকোপ কিছুটা কমায় সেপ্টেম্বর থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ঋণ নিয়ে নতুন করে শুরু করেছিলাম ফুলের আবাদ। কিন্তু ৪ মাস ফুল পরিচর্যা করে ফুলের ভরা মৌসুমে এসে নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রনে সামনের দিবসগুলোতে ফুল বেচাকেনায় সংশয়ে রয়েছি।

গদখালির টাওয়া গ্রামের কৃষক নিমাজ উদ্দিন বলেন, করোনার কারণে গত বছর বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পয়লা ফাল্গুনে কোনো উৎসব না হওয়ায় ফুল বিক্রি করতে পারেনি। তবে গেল বছরের সেপ্টেম্বর থেকে করোনা স্বাভাবিক হওয়ায় ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান হওযায় ফুল বেচাকেনা ছিলো ভালো। এবারও ভালোবাসা দিবস ও পয়লা ফাল্গুনে আসন্ন সময়ে করোনা হানা দিয়েছে। তাই এ বছরও কত টাকার ফুল বিক্রি হবে, তা নিয়ে অবশ্য শঙ্কায় আছেন তিনি। কারণ, চলমান করোনা পরিস্থিতিতে দেশে সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ। উৎসব আয়োজনও হচ্ছে না। অনেক ফুলচাষি অতীতের মতো ফুল বিক্রি হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন।

হাড়িয়া গ্রামের ফুল চাষি আলমগীর জানান, লকডাউনের কারণে গেল দুই বছর ফুল বেচাকেনা করতে না পেরে নিঃস্ব হতে বসেছিলাম। কেউ কেউ ফুলের আবাদ কমিয়ে অন্য ফসলের আবাদ করছে। তিনি বলেন গত কয়েক মাস ফুল পরিচর্যা করে ফুলের ভরা মৌসুমে এসে নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রনে সামনের দিবসগুলোতে ফুল বেচাকেনা হকে কিনা সেই দুঃশ্চিন্তায় ভর করেছে।

গদখালি ফুলের বাজারে কথা হয় হাড়িয়া গ্রামের রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ওমিক্রনের প্রভাবে ফুলের দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। আগে প্রতি হাজার গাঁদা ফুল বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকা। এখন ১০০ টাক। একেকটি গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ১ টাকা। যা আগে বিক্রি হয়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা। রজনীগন্ধা একেকটি বিক্রি হচ্ছে ২ থেকে ৩ টাকায়, যা আগে ছিল ৫-৬ টাকায়। রঙিন গ্লাডিউলাস প্রতিটি মান ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৪-৫ টাকায়, যা আগে ছিল ৬-৭ টাকায়। জারবেরা বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকায়, যা আগে দাম ছিল ৮-১০ টাকায়। ফুল বাঁধার জন্য কামিনীর পাতা বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকা আঁটি, যা আগে ছিল ৩০-৪০ টাকা।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ারস সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম জানান, আম্ফান ও করোনার কারণে কৃষি সেক্টরের মধ্যে ফুলচাষিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সারা দেশে প্রায় ১ হাজার থেকে ১২শ’ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ফুলের রাজ্যখ্যাত এ অঞ্চলেই ৩ থেকে ৪ শ’ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষকরা ইংরেজি নববর্ষ, বসন্ত উৎসব, ভালোবাসা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পহেলা বৈশাখের বাজার ধরতে কৃষকরা ফুল চাষ, পরিচর্যা করছে। করোনার তৃতীয় ঢেউে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ফিকে হতে চলেছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন