চার-পাঁচ বছর আগে শেষ হয়েছে পলিসির মেয়াদ। অথচ আজও হাজারেরও বেশি গ্রাহকের বীমা দাবির টাকা পরিশোধ করা হয়নি। এমন অভিযোগ উঠেছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের বিরুদ্ধে। সরজমিনে এসব অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দৈনিক আনন্দবাজার। গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধ করা নিয়ে কালক্ষেপণ করা কিংবা মিথ্যা আশ্বাস দেয়া নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক নাঈম কামাল।
তিন থেকে পাঁচ বছর আগে পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চুক্তি অনুযায়ী চেক দেয়া হয়েছে। তবে, ব্যাংকের সেই একাউন্টে নেই টাকা। এ অবস্থায় চেক নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন গ্রাহকরা। সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে উত্তরের জেলা বগুড়ায়। সেখানে গ্রাহকদের অভিযোগের পাহাড় জমা হয়েছে। ফাইলের পর ফাইল জমা পড়ে আছে শাখা অফিসে। অবস্থা বেগতিক দেখে ফাইল জমা নেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি গ্রাহকের করা মামলায় পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। বীমা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) বলছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলায় বাড়ি সেলিনা বেগমের। তিনি আর্থিক স্বচ্ছলতার কথা ভেবে ২০০৬ সালে সানলাইফে পলিসি কেনেন। যার প্রিমিয়াম বাবদ প্রতিমাসে ১০০ টাকা করে পরিশোধ করেন। এভাবে ১০ বছরে জমা করেন ১২ হাজার টাকা। পলিসির মেয়াদ শেষ হয় ২০১৭ সালে। বীমা দাবির টাকা বুঝে পেতে ঘুরতে শুরু করেন মাঠকর্মী এবং শাখা অফিসে। এভাবে দুই বছর ঘোরার পর ২০১৯ সালে একটি চেক বুঝে পান। যেখানে শুধু জমা দেয়া টাকার পরিমাণ উল্লেখ ছিলো। লাভ দেয়ার কথা থাকলেও চেকে সে টাকার অংক উল্লেখ করেনি কোম্পানি। তবুও খুশি ছিলেন গ্রাহক। অন্তত মূল টাকা তো পাচ্ছেন। তবে এটাও যে আরেকটা মিথ্যা আশ্বাসের ফাঁদ তখনও বুঝতে পারেননি সেলিনা বেগম। তিনি বাড়ি যাওয়ার পর দেখতে পান চেকে দেয়া একাউন্ট নাম্বারে সংখ্যাগত ভুল।
সেলিনা বেগম আনন্দবাজারকে জানান, তার সঙ্গে দেয়া ১৯টি চেকেই একেকটা ভুল করে রাখা হয়েছে। কারও নামে ভুল। কারও একাউন্ট নাম্বারে আবার কারও বা পলিসি নাম্বারে ভুল। চেক সংশোধন করাতে আবার ঘুরতে হয়েছে দ্বারে দ্বারে। পরে সংশোধন করার কথা বলে চেকগুলো ফেরৎ নিয়ে নেয় কোম্পানির লোকজন। সেগুলো সংশোধন হয়ে আর আমাদের কাছে ফিরে আসেনি। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ১৯ জন মিলে ২০২০ সালে একটি মামলা করি বগুড়া জেলা জজ আদালতে। মামলায় আসামি করা হয় ছয় জনকে। এর মধ্যে পাঁচজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তবে এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি।
প্রতারণার শিকার গ্রাহক সেলিনা বেগম পলিসি কেনেন মাঠকর্মী মমতাজ বেগমের মাধ্যমে। মমতাজের বাড়িও গাবতলী উপজেলায়। তিন আনন্দবাজারকে বলেন, আমি এলাকায় ঘুরে ঘুরে দরিদ্র মানুষকে আর্থিক স্বচ্ছলতার স্বপ্ন দেখিয়েছি। খেটে-খাওয়া এসব মানুষ আমার পরামর্শে সানলাইফ থেকে পলিসি কিনেছেন। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কোম্পানি থেকে টাকা দেয়া হচ্ছে না। তারা দিবো, দিচ্ছি বলে সময় ক্ষেপণ করতে করতে পাঁচ বছর পার করে দিয়েছে। তবে এর মধ্যে কয়েকজনকে চেক দিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। তখন বুঝতে না পারলেও এখন আমাদের কাছে প্রমাণ আছে।
মমতাজ বেগম আরো বলেন, তারা সব গ্রাহকের সঙ্গে এ ধরনের প্রতারণা করে যাচ্ছে। চেকে ইচ্ছ করে ভুল লিখে দিচ্ছে। যাতে করে সংশোধনের নামে আরও বেশি সময়ক্ষেপণ করার সুযোগ পায়। হয়তো তাদের আশা, এভাবে হয়রানির শিকার হতে হতে গ্রাহক একসময় চুপ হয়ে যাবে। আর তারা গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধ না করে পার পেয়ে যাবে। মমতাজ খানিকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা ছেড়ে দেয়ার পাত্র না। এই সানলাইফের কারণে পদে পদে গ্রাহকের কাছে অপমাণিত হয়েছি। অনেকে হামলার শিকার হয়েছে। তবুও তারা আমাদের নিরাপত্তার কথা ভাবেনি। আমাদের কোনো অভিযোগ তারা গ্রহণ করেনি। বরং গ্রাহকদের হয়রানির পর হয়রানি করে আমাদের বিরুদ্ধে এক প্রকার উসকে দিয়েছে।
একই পরিস্থিতির শিকার গাবতলীর জাকিয়া সুলতানা। তিনি ছিলেন বাইগুনি পশ্চিম শাখার ডেপুটি ম্যানেজার (ডিএম)। শাখাটির অবস্থান ছিল বাইগুনি গ্রামে। জাকিয়া আনন্দবাজারকে বলেন, সানলাইফ আমার জীবনকে শেষ করে দিয়েছে। তারা গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধ করছে না। প্রতিনিয়তই গ্রাহকরা এসে আমাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। মান-সম্মান আর কিছুই রইলো না। সানলাইফ একাধিক গ্রাহককে চেক দিয়েছে। একের পর এক ভুল ধরা পড়ায় চেকগুলো তারা আবার ফেরৎ নিয়ে যায়। কিন্তু সেগুলো সংশোধন হয়ে আর ফেরৎ আসে না। একদিকে গ্রাহকের চাপ অন্যদিকে কোম্পানি থেকে হুমকি-ধমকিও দেয়া হচ্ছে। কোম্পানিটি এক মন্ত্রীর বোনের প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করে তিনি বলেন, একারণে অনেকে প্রধান কার্যালয়ে যাচ্ছে না। তবে আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলে হুমকি দিচ্ছে। আমি এখন কোথায় যাবো? কারও কাছে গিয়ে কোনো প্রকার সহযোগিতাও পাচ্ছি না।
সানলাইফ ইন্সুরেন্সের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পাওয়া পায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায় কোম্পানির পরিচালক ও মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে (সিইও) অবরুদ্ধ করে রেখেছেন প্রতারণার শিকার গ্রাহকরা। তারা এসেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। একের পর এক বাধা পেরিয়ে তারা ঢুকে যায় সিইওর কক্ষে। সেখানে শুরু হয় হট্টগোল। পরে অনেক বুঝিয়ে এবং বীমা দাবি পরিশোধের আশ্বাসে শান্ত করা হয় তাদের। গ্রাহকদের অভিযোগ, ২০১৬ সালে শেষ হওয়া বীমার টাকা এখনও বুঝে পাননি তারা। মানিকগঞ্জ থেকে আসা নুরজ্জামান নুর নামে এক গ্রাহক ১৫ হাজার ২৬০ টাকার একটি চেক দেখিয়ে বলেন, অনেক হয়রানির পর চেক পেয়েছি। খুশি মনে টাকা তুলতে গিয়ে দেখি একাউন্ট নাম্বার ভুল। এখন সংশোধনের জন্য এসেছি।
অভিযোগের বিষয়ে সানলাইফ ইন্সুরেন্সের পরিচালক ও নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নুরুল ইসলাম বলেন, চেকে ভুল হতেই পারে। আমরা চেষ্টা করছি স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে। প্রায় সবগুলো চেকে কীভাবে ভুল হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নুরুল ইসলাম বলেন, আপনি তো শুধুমাত্র একজন রিপোর্টার। আপনাকে দেয়ার মতো সময় আমার কাছে নেই। আমি মাঝে মাঝে সম্পাদক লেভেলের দুয়েকজনকে কিছুটা সময় দিতে পারি। প্রতিবেদন তো রিপোর্টাররাই তৈরি করেন, সেজন্য সময় তো তাদেরই দিতে হবে- এমন প্রসঙ্গে কোনো কথা না বলে উঠতে উঠতে বলেন, আমার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে এখন উঠতে হচ্ছে। এখন আসতে পারেন বলে রুম থেকে বের হয়ে যান।
অভিযোগের বিষয়ে বীমা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক (যুগ্মসচিব) এসএম শাকিল আখতার আনন্দবাজারকে বলেন, এধরনের প্রতারণার কোনো সুযোগ নেই। গ্রাহকের টাকা পরিশোধে তাদের আলটিমেটাম দেয়া হয়েছে। আমাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে তারা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সুনাম নষ্ট করছে। অনেক গ্রাহক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বোনের সংশ্লিষ্টতার ভয়ে অভিযোগ করছে না। আমরা শিগগিরই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। গ্রাহকের বিমা দাবির টাকা পরিশোধ না করে পার পেয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আনন্দবাজার/শহক