ঢাকা | রবিবার
১৫ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১লা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

লবণ নীতিমালায় নতুন প্রত্যাশা

দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় লবণ উৎপাদনে সাফল্য দেখাচ্ছেন দেশের কৃষকরা। তাদের হাত ধরেই বড় হয়েছে লবণশিল্প। তবে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না লবণচাষিরা। তাদের একটিই আতঙ্ক ‘আমদানি’। লবণ আমদানির খবর শুনলেই চাষিরা হতাশ হয়ে পড়েন। তারা বলছেন, বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করা হলে দেশীয় লবণের দাম পড়ে যায়। তখন চাষিদের উৎপাদিত লবণ বিক্রি করে ন্যায্য মূল্য পাওয়া যায় না।

উপকূলীয় জেলাগুলোতে সনাতনী পদ্ধতিতে লবণ চাষ হচ্ছে। এর পরিমার্জন দরকার। ২০২০-২৫ মেয়াদী নীতিমালা বাস্তবায়ন করলে লবণ উৎপাদনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন হবে। লবণের ঘাটতি হবে না

-খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, মন্ত্রিপরিষদ সচিব

দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় লবণ উৎপাদনে সাফল্য দেখাচ্ছেন দেশের কৃষকরা। তাদের হাত ধরেই বড় হয়েছে লবণশিল্প। তবে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না লবণচাষিরা। তাদের একটিই আতঙ্ক ‘আমদানি’। লবণ আমদানির খবর শুনলেই চাষিরা হতাশ হয়ে পড়েন। তারা বলছেন, বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করা হলে দেশীয় লবণের দাম পড়ে যায়। তখন চাষিদের উৎপাদিত লবণ বিক্রি করে ন্যায্য মূল্য পাওয়া যায় না।

সূত্রমতে, দেশে লবণের জাতীয় চাহিদা বর্তমানে ২২ লাখ টন। গত ২০১৭ সালে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মাত্র ৬০ হাজার টন লবণ কম উৎপাদনের সুযোগ নিয়ে বড় একটি সিন্ডিকেট কয়েক লাখ টন লবণ বিদেশ থেকে আমদানি করে। সেই তখন থেকেই নানা কৌশলে সিন্ডিকেটটি তৎপর হয়ে পড়ে আমদানিতে। তখন থেকেই দুর্ভোগ নেমে এসেছে লবণ চাষিদের।

লবণচাষিরা হতাশ হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী একমাত্র দেশীয় লবণ শিল্পটি ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন অনেকে। সোডিয়াম ক্লোরাইড এবং সোডিয়াম সালফেটের নাম দিয়ে বিদেশ থেকে ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে ঢালাও লবণ আমদানিতে চাষিরা দেশীয় লবণ উৎপাদনে আগ্রহ হারাচ্ছেন এমনটাই দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।

শিল্প কারখানার নামে যেকোনোভাবে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি বন্ধের দাবি চাষীদের। তারা বলছেন, শিল্প কারখানার নামে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি করায় করের পরিমাণ অনেক কম। এতে সরকারের রাজস্ব যেমনি ক্ষতি তেমনি দেশীয় লবণ শিল্পের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ে। তবে এখন পর্যন্ত এসব দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় লবণ শিল্পে দুর্গতি লেগেই রয়েছে বলে জানান স্থানীয় লবণ চাষীরা।

সূত্রমতে, দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদন কেন্দ্র হচ্ছে কক্সবাজারের ছয়টি উপকূলীয় উপজেলা কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, রামু, টেকনাফ ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের সাতটি উপজেলায় লবণ উৎপাদনযোগ্য প্রায় ৭০ হাজার একর উপকূলীয় জমি রয়েছে। উৎপাদিত লবণের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার কারণে দিন দিন লবণ চাষ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে বলে তথ্য দিচ্ছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, ইতোমধ্যে প্রায় ১৬ হাজার একর জমিতে বন্ধ হয়ে গেছে লবণচাষ।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প সংস্থা-েবিসিকের কক্সবাজারস্থ লবণ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, গত মৌসুমে ৫৪ হাজার ৬৫৪ একর জমি লবণ চাষের আওতায় এসেছে। ২০২০ সালে উৎপাদন মৌসুমেও লবণ চাষের আওতায় উপকূলীয় জমির পরিমাণ ছিল ৫৭ হাজার ৭২২ একর জমি। গত এক বছরেই ৩ হাজার একর জমির চাষ কমে গেছে। লবণ চাষীরা একটানা গত ৪ বছর ধরেই তাদের উৎপাদিত লবণের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। ২০১৭ সাল থেকে লবণের দাম পড়ে যাওয়ায় উপকূলের চাষীরা তাদের বাপ-দাদার ঐতিহ্যের পেশাটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

স্থানীয়দের দেয়া তথ্যমতে, মাঠ পর্যায়ে লবণের উৎপাদন খরচই হচ্ছে মণপ্রতি ২৪০ টাকা অর্থাৎ এক কেজিতে ৬ টাকা। আর সেই লবণ চাষিদের বিক্রি করতে হচ্ছে মণে (সর্বোচ্চ দাম) ১৬৩ টাকা অর্থাৎ কেজি প্রতি ৩ টাকা ২৫ পয়সা করে। কেবল চাষিরা নয় লবণ ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরাও রয়েছেন ক্ষতির মুখে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারের ইসলামপুর লবণ শিল্প কেন্দ্রের ৭০টির মধ্যে ৪০টি লবণ মিল বন্ধ হয়ে গেছে।

সারাদেশে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি কেজি ৩০/৪০ টাকা করে লবণ বিক্রেতা কম্পানিগুলো আগে কক্সবাজারের মাঠ পর্যায়ে লবণ ক্রয় সেন্টার খুলে বসতো। তবে তারা এখন মাঠ থেকে লবণ কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। এসব কম্পানি শিল্পকারখানার আড়ালে আমদানি করা বিদেশি লবণ প্যাকেটজাত করে বিক্রি করে আসছে। এতকাল কক্সবাজারের লবণ দিয়েই ডিটারজেন্ট তৈরি হয়ে আসছে। গার্মেন্ট কারখানায় ব্যবহার হয়ে আসছে কক্সবাজারের লবণ। তবে উৎপাদনকারীদের অভিযোগ, গত কয়েক বছর ধরে কক্সবাজারের লবণ তারা নিচ্ছে না। বিসিকসহ সরকারি বেসরকারি পর্যায়েও এসবের তদারকি দেখা যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে।

শিল্প কারখানার নামে আমদানি করা সোডিয়াম ক্লোরাইড দেশীয় লবণের চেয়েও দাম কম পড়ে এবং সাদাও বেশি বিধায় দেশীয় উৎপাদিত লবণ বাদ দিয়ে কম্পানিগুলো এসব প্যাকেটজাত করে বিক্রি করে থাকে। শিল্পকারখানায় ব্যবহারের জন্য কেবল লিকুইড সোডিয়াম সালফেট আনার ব্যবস্থা করা হলে ব্যবহার্য লবণ আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে। এতে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে তেমনি দেশীয় লবণ নিয়ে জাতীয় চাহিদাও মিটানো সম্ভব হবে।

গত সোমবার ‘জাতীয় লবণ নীতিমালা-২০২২’ এর খসড়ার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, এখন লবণ চাষের ক্ষেত্রে দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে উপকূলীয় জেলাগুলোর অনেকগুলোয় চিরাচরিত পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে। সেটার আধুনিকায়ন দরকার। মাতারবাড়ি, কক্সবাজার, পায়রায় বেশকিছু জায়গায় উন্নয়ন কাজে নিয়েছি। সেজন্য নতুন নতুন জায়গায় উদ্ভাবন করা এবং নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে আরও কার্যকরী উৎপাদন এবং বড় করার জন্য নীতিমালা নেওয়া হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ২০২০-২৫ মেয়াদী এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করলে আমরা লবণ উৎপাদনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করবো এবং আমাদের লবণের ঘাটতি হবে না।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন