মৌমাছিসহ অন্যান্য পতঙ্গের মাধ্যমে ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি মধু নামের মিষ্টি, ঘন তরল পদার্থের গুণাগুণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা শুরু হয়েছে করোনা মহামারির সময়ে। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়ার কারণে মধুর চাহিদা মহামারিকালে অনেক বেড়ে গেছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে সনাতনী পদ্ধতি ছেড়ে মধুর বাণিজ্যিক চাষে ব্যাপক আগ্রহী হয়ে উঠেছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। সারাদেশে মৌচাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য মাস্টার ট্রেইনার তৈরিসহ গবেষণা কাজও শুরু হয়েছে। চাষিরাও উৎসাহিত হচ্ছে মৌচাষে। বিশেষ করে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী বিশাল এলাকা জুড়ে সরিষার মাঠে বাণিজ্যিক মৌচাষের সম্প্রসারণ ঘটছে।
মূলত, আবহমানকাল ধরেই ভারতীয় উপমহাদেশে সনাতনী পদ্ধতিতে মধু আহরণ করা হতো। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত বাংলাদেশে মধুর বাণিজ্যিক চাষের তেমন কোনো প্রচলন ছিল না। তবে স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) আধুনিক পদ্ধতিতে মৌচাষ কর্মসূচি চালু করে। এর মাধ্যমেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌবাক্সে মধুচাষ ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ পদ্ধতিতে মধু উৎপাদনে অ্যাপিস মেলিফেরা ও অ্যাপিস সেরেনা প্রজাতির মৌমাছি ব্যবহার করা হয়। মৌচাষ সম্প্রসারণ ও কার্যক্রম জোরদারে ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মৌচাষ উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিসিক।
সূত্রমতে, বিসিক বাণিজ্যকভাবে এখন পর্যন্ত ২৫ হাজারের বেশি মৌচাষিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কাঠের বাক্সে মৌচাষের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। মৌচাষ সম্প্রসারণে মৌমাছি পালনে স্থায়ী ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হচ্ছে। পাশাপাশি পুরোনো মোচাষি ও সুন্দরবন অঞ্চলের মৌয়ালসহ প্রাকৃতিক মৌয়ালীর দক্ষতা বাড়ানোর কার্যক্রম চলছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মৌচাষিদের সহজ শর্তে ঋণও দেয়া হচ্ছে। বিসিকের নানামুখী এসব উদ্যোগের ফলে দেশে মৌচাষির সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি চাষের আওতাও বাড়ছি দিন দিন। বর্তমানে দেশে প্রায় দশ হাজারের বেশি মৌচাষি মধু উৎপাদনে নানাভাবে কাজ করছেন। সরকার মৌচাষে উপযোগী আরো ডজনখানেক জেলায় বিশেষ খামার সৃষ্টি করে মধু উৎপাদন জোরদার করছে।
মৌচাষিরা বিভিন্ন এলাকায় সরিষা, লিচু, কালোজিরা, ধনিয়া ফুলের মধু সংগ্রহ করছেন। তাছাড়া সুন্দরবন অঞ্চলে খামার স্থাপনের মাধ্যমে মৌচাষ হচ্ছে। বিগত সময়ে ১০ হাজার টনের বেশি মধু উৎপাদন হয়েছে। বর্তমানে দেশে মধুর বাৎসরিক চাহিদা বেড়ে ৪০ হাজার টনের বেশি হয়েছে। তবে মধুর উপকারিতা সম্পর্কে অনেকের মধ্যে অস্পষ্টতা থাকায় মধুর বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে ধীর গতি দেখা যাচ্ছে। তবে সুন্দরবন কিংবা নদী তীরবর্তী অঞ্চল ছাড়াও মধুর চাষের আওতা দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে মৌচাষের ক্ষেত্র বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে মৌচাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন অনেকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের উত্তর জনপদের ১৬ জেলায় সরিষা ক্ষেত, লিচু এবং আম বাগানে পরিকল্পিতভাবে মৌচাষ করে মধু উৎপাদনের মাধ্যমে বছরে শত কোটি টাকা আয়ের অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেছে। সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে লক্ষাধিক বেকার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সেই সঙ্গে সাথী ফসল থেকে বাড়তি আয় উত্তরাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, রংপুরের অতিরিক্ত পরিচালক মাহবুবর রহমান দৈনিক আনন্দবাজারকে জানান, রংপুর অঞ্চলের রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জয়পুরহাট এবং নীলফামারী জেলায় বিপুল পরিমাণ আম এবং লিচু বাগান ছাড়াও বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেতে মৌচাষ করে প্রতি বছর শত কোটি টাকার মধু উৎপন্ন করার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কারিগরি সহযোগিতায় গত কয়েক বছর ধরে এসব জেলায় বিভিন্ন সরিষা ক্ষেত ছাড়াও লিচু এবং আমবাগানে মৌচাষ করার পাশাপাশি সাথী ফসল থেকে বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এই কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। চাষীদের ক্রমবর্ধমান উৎসাহের কারণে তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণসহ ইতোমধ্যে শতাধিক উন্নত মানের মৌবক্স সরবরাহ করা হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মৌচাষ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ রাকিবুল ইসলাম আনন্দবাজারকে জানান, প্রতিটি মৌবক্সে প্রতি মৌসুমে ন্যূনতম ১০ থেকে ২০ কেজি করে মধু পাওয়া যায়। এছাড়া মৌচাষের প্রকল্পভুক্ত সরিষা ক্ষেতের ফলনও অন্তত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়। পাশাপাশি ঐ এলাকায় বিভিন্ন ফলের গাছের মুকুল এবং ফসলের ক্ষেতে মৌমাছির ব্যাপক সমাগমের মাধ্যমে প্রচুর পরাগায়নের সৃষ্টি হয়। যে কারণে ঐসব ফলের বাগান এবং ক্ষেতের ফলনও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এই কর্মসূচির আওতায় গত অর্থবছরে এসব জেলার বিভিন্ন সরিষা ক্ষেতে তিন হাজার ৫৭৪টি মৌবক্স স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা ধরে এই অঞ্চলে দুই হাজার ৬শ ৯৬টি মৌমাছির বক্স স্থাপন কারা হয়েছে। এর মাধ্যমে চাষিরা সাথী ফসল হিসেবে বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি করতে পেরে অর্থনৈতিকভাবে প্রচুর লাভবান হয়েছে। এই কর্মসূচি আওতায় কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলায় সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রমতে, রংপুর বিভাগের রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট এবং নীলফামারী এই ৫ জেলায় গত ২০২০-২১ রবি মৌসুমে ৩৮ হাজার ৪৩৩ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়। এসব সরিষা ক্ষেতের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে মধু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে দুই হাজার ৯৫০টি মৌমাছির বক্স স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে গোটা মৌসুম জুরে কেবল এসব সরিষা ক্ষেতে দুই হাজার ১৮৯টি মৌ বক্স স্থাপন করে ২১ হাজার ৮০৬ কেজির বেশি মধু উৎপন্ন হয়েছে। এছাড়া এসব জেলার বিভিন্ন আম বাগানে ২২২টি মৌবক্স স্থাপন করে আরও ৫ হাজার ৯০৪ কেজি এবং বিভিন্ন লিচু বাগানে ২৮৫টি মৌবক্স স্থাপন করে অতিরিক্ত ৫ হাজার ৯০৪ কেজি মধু উৎপন্ন হয়েছে।
তবে চাষ করা সব সরিষাক্ষেত এবং আম ও লিচুবাগানে পরিকল্পিতভাবে মৌচাষ প্রকল্পের অর্ন্তভুক্ত করা সম্ভব হলে এসব উৎস থেকে প্রতি মৌসুমে মৌচাষ করে আরও অন্তত ২৫ থেকে ৩০ লাখ কেজি মধু উৎপন্ন করা সম্ভব হবে। অপরদিকে অবহেলিত রংপুর অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তির ভাণ্ডার তৈরি হবে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে রংপুর জেলায় সরিষা চাষ হয়েছে ৬ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ১১০ হেক্টর জমির সরিষা ক্ষেতে ৫২টি মৌবক্স স্থাপন করে ১৪৪ কেজি এবং জেলার ১৬৫ হেক্টর জমিতে চাষ করা লিচু বাগানের মধ্যে ১৫৩ হেক্টরে ৮৫টি মৌবক্স স্থাপন করে ৫ হাজার ৯০৪ কেজি মধু উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া ৫ হেক্টর আমবাগানে ২২টি মৌবাক্স স্থাপন করে ১৩ কেজি মধু উৎপন্ন হয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলায় ১৩ হাজার ৭৬৫ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৩৫০ হেক্টর সরিষা ক্ষেতে ১ হাজার ৮৫০ টি মৌবক্স স্থাপন করে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি।
গাইবান্ধা জেলায় ১০ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২২০ হেক্টর সরিষা ক্ষেতে ৩০০টি মৌবক্স স্থাপন করে ৩ হাজার কেজি মধু পাওয়া গেছে। জেলার ৭০ হেক্টর জমিতে চাষ করা লিচু বাগানের মধ্যে ৫০ হেক্টরে ২০০টি মৌবক্স স্থাপন করে ১০ হাজার কেজি মধু উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া ৩০ হেক্টর আমবাগানে ২০০টি মৌবক্স স্থাপন করে আরও ৯ হাজার কেজি মধু উৎপন্ন হয়েছে। নীলফামারী জেলায় ৫ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। এর মধে ২৫০ হেক্টর সরিষা ক্ষেতে ১৭টি মৌবক্স স্থাপন করে ২৫০ কেজি মধু উৎপন্ন হয়েছে।
লালমনিরহাট জেলায় দুই হাজার ১৫৮ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ হেক্টর সরিষা ক্ষেতে ৩টি মৌবক্স স্থাপন করে ২০ কেজি মধু উৎপন্ন হয়েছে। সীমিত পর্যায়ে মৌমাছি চাষে সাফল্য অর্জিত হওয়ায় রংপুর বিভাগের ৫ জেলায় গত রবি মৌসুমে প্রায় ৩ কোটির বেশি টাকা মূল্যের ৫৫ হাজার কেজিরও বেশি মধু উৎপাদন হয়েছে।
প্রত্যেক গ্রীষ্ম মৌসুমে মধু সংগ্রহের জন্য রংপুর অঞ্চলে যান সিরাজগঞ্জের মৌসুমী মৌয়াল চান মিয়া। তিনি তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, সাধারণত এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মধু সংগ্রহ শুরু হয়। তিনিসহ অন্য মৌয়ালদের অভিযোগ, দেশে আমবাগান এবং লিচু বাগানে মৌচাষ বা মধু সংগ্রহের জন্য কোনো নিয়ম শৃঙ্খলা নেই। বাজারজাত করার ব্যাপারেও কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। এ ব্যাপারে সুষ্ঠু বাজারব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে কেবল মৌচাষ করেই রংপুর অঞ্চলের চাষীরা শত কোটি টাকা আয় করতে পারবেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, রংপুরের অতিরিক্ত পরিচালক দফতরের উপপরিচালক মাহবুবর রহমান আনন্দবাজাকে জানান, রংপুর অঞ্চলে লিচু এবং আম বাগানসহ সরিষা ক্ষেতে মৌচাষ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য মাস্টার ট্রেইনার তৈরি ও গবেষণা কার্যক্রম চলছে। উত্তরাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৌচাষ ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। চাষিরাও দিন দিন মৌচাষে উৎসাহিত হচ্ছে। বিশেষ করে নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ সরিষার মাঠে মৌচাষে উৎসাহ বাড়ছে। তবে দক্ষ মৌয়ালের অভাবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সময় লাগছে।
আনন্দবাজার/শহক