ঢাকা | সোমবার
১৪ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৩০শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কঠোর নিয়মে বাণিজ্যিক ব্যাংকখাত

কঠোর নিয়মে বাণিজ্যিক ব্যাংকখাত

দেশের গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অন্যতম ব্যাংকিং। গত চার দশকে ব্যাংকখাতে নানা আলোচিত সমালোচিত ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘদিনের এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গ্রাহক আর সাধারণের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া আস্থাহীনতার সংকট কাটাতে উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকখাতে বিগত সময়ে বিভিন্নভাবে দুই লাখ ৫১ হাজার ৭শ কোটি টাকার হিসাবে অনিয়ম হয়েছে। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে কিছু সমালোচনা বিদেশেও পৌঁছে গেছে। সেসব নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যেও আলোচনা সমালোচনা চলছে। ব্যাংকখাতের এসব অপ্রীতিকর ঘটনা ও অনিয়ম দূর করে গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে কাঠোর অবস্থানে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। অনিয়ম প্রতিরোধে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করা হচ্ছে।

ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলো পুনর্গঠন করার ফলে গোটা ব্যাংকিংখাতই চলে আসছে নিয়মের মধ্যে। তদারকির শুরুতেই বিভাগগুলোর প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে ব্যাংক পরিদর্শনের চারটি বিভাগকে ভেঙে আটটি করা হচ্ছে। আগে যেখানে চারটি বিভাগে কাজ করতেন ছয়জন মহাব্যবস্থাপক, সেখানে আটটি বিভাগে কাজ শুরু করেছেন ৮ জন মহাব্যবস্থাপক। কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর বেশি নজর দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমন উদ্যোগের ফলে ব্যাংকখাতে যেকোনো অনিয়ম শুরুতেই থামিয়ে দেয়া সম্ভব বলে মনে করছেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। বিদায়ী বছরের মাঝামাঝিতে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করে সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের অবহিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র বলছে, ব্যাংক পরিদর্শন ও পরিপালন কার্যক্রম অধিকতর গতিশীল করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের বিদ্যমান ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-১, ২, ৩ ও ৪ অবলুপ্ত করা হয়েছে। নতুনভাবে ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ ও ৮ নামে আটটি বিভাগ গঠন করে কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে বিভাগগুলো জরুরিভাবে কাজও শুরু করেছে। ব্যাংকখাতের অনিয়মের ব্যাপারে নিয়মিত পরিদর্শন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে কর্মী ও বিভাগের সংখ্যা আরো বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য বিভাগ বাড়িয়ে নতুন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশেষ সূত্র।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র দৈনিক আনন্দবাজারকে জানান, ব্যাংকখাত গতিশীল করতে লোকবলও বাড়ানো হয়েছে। এসব বিভাগের ব্যাংকগুলো পরিদর্শনের আওতা আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। বিদায়ী বছরের ৪ মে এ বিষয়ে দুটি সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেখানে ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের ৮টি বিভাগে যারা মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করবেন তাদের নাম উল্লেখ করা হয়। এতে পরিদর্শন বিভাগের কর্মকর্তারা ব্যাংকগুলো পরিদর্শনের আরও বেশি ক্ষমতা পেয়েছেন।

তদারকির নতুন কাঠামোর বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে অবহিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগকে দায়িত্ব দেয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে উপমহাব্যবস্থাপক, যুগ্ম পরিচালক, উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালকের পদ। ব্যাংক তদারকি ও নীতি প্রণয়নে দায়িত্বে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ (বিআরপিডি)। প্রক্রিয়াকরণের প্রথম থেকে এ বিভাগের কার্যক্রম দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি অংশ নীতি প্রণয়ন করছে। অপর অংশ দেখভাল করছে। আগে সব বিভাগের দায়িত্বে যেখানে একজন মহাব্যবস্থাপক ছিলেন, এখন সেখানে থাকছেন দুজন।

সূত্রমতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যান্য শাখাতেও জনবল বাড়ানো হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তদারকিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে। নতুন কাঠামোতে সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোর প্রযুক্তির সক্ষমতাও বাড়ানো হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারির জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগকে পুনর্গঠন করা হয়েছে। তবে প্রচলিত কাঠামো থেকে বের করে আনতে কিছুটা সময় লাগবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর্থিক কেলেঙ্কারির কিছু ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে সে ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা দৈনিক আনন্দবাজাকে বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতি-অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বদ্ধপরিকর, কাউকে ছাড় নয়।

সূত্রমতে, গত এক যুগ ধরে ব্যাংকখাতের বড় ধরনের অনিয়মের মধ্যে রয়েছে হলমার্ক গ্রুপের চার হাজার কোটি টাকা, ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচ হাজার কোটি টাকা, এ্যাননটেক্স গ্রুপের সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা, বিসমিল্লাহ গ্রুপের এক হাজার ২০০ কোটি টাকা, সানমুন স্টার গ্রুপের এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনা। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম প্রমাণিত হলেও লোপাট হওয়া অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

নজরদারির কারণে গেল বছর করোনামহামারির পর থেকে ব্যাংকখাতের ঋণ বিতরণে অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রণোদনার ঋণ ছাড়া অন্য ঋণ বিতরণ সীমিত করা হয়েছে। করোনার আগে বিশেষ সুবিধা দিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে। তবে সাত ব্যাংকের সাড়ে ছয় হাজার দুশ কোটি টাকা এখনও উদ্ধার করা যায়নি। শীর্ষ তালিকায় অবস্থান করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিস্তিসহ নানা সুযোগ সুবিধা দিলেও কোনো সাড়া মিলেনি। নতুন ঋণের তালিকায় খেলাপির সংখ্যা তেমন না দেখা গেলেও বিগত ঋণ খেলাপির তালিকা বাড়ছে। যুক্ত হচ্ছে কেউ না কেউ। দেশে ব্যবসার ধরন নানা পথে আধুনিকায়ন হলেও ঋণ প্রক্রিয়া আগের মতোই রয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নজরদারি বাড়িয়ে অগ্রসর পন্থায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিক সুবিধার আওতায় এনে ঋণ প্রক্রিয়া চালু করলে আর্থিকখাত লাভবান হবে। পাশাপাশি সৃষ্টি হবে শক্তিশালী কর্মসংস্থান। ঋণ মাত্রায় কিস্তির সুবিধা দেওয়ায় অনেক ব্যাংক সুশাসনের আওতায় আসতে সক্ষম হয়েছে। খেলাপিদের জামানত সম্পদ বিক্রি বণ্টন এখনও সুবিধাভোগী চক্রের হাতে। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন পদক্ষেপ সফল হচ্ছে। অনিয়মে চলা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিয়মের মধ্যে আসতে শুরু করেছে।

অনেকেই বলছেন, নতুন উদ্যোগ নেয়ার ফলে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কঠোর নিয়মের মধ্যে পরিচালিত হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠা পাবে সুশাসন। এতে জাতীয় অর্থনীতি আরো গতিশীল হবে।বে -শিক্ষা মন্ত্রণালয়

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন