‘দিন আনি দিন খাই, হামার গরিব মাইনসের একটেও ভালা নাই। এমনিতে জিনিসপত্রের যা দাম তাতে জীবনে বাঁচে না। তার ওপর ফির করোনার জন্য সরকারি বিধি-নিষেধ! লোকজনের চলাচল আগের মতন না থাকলে হামার কামাইয়ে (আয়) হবার নয়।’ বর্তমান সময়ের দিনকাল নিয়ে এমন শঙ্কার কথা বলেন কাউনিয়া উপজেলার গ্রাম থেকে আসা রংপুর নগরীর রিকশাচালক ময়েন উদ্দিন। শুধু তিনিই নন, চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমুখী বাজারের পাশপাশি করোনার বিস্তার রোধে নতুন করে বিধি-নিষেধ আরোপের খবরে অনেকটাই হতাশ উত্তরাঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষ।
শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত উত্তরের ১৬ জেলায় আমন ধানের কাটামাড়াই শেষ হয়েছে অনেক আগেই। কৃষকের উঠানে থরে থরে সাজানো এখন ধানের আঁটির স্তূপ। চলছে মাড়াইয়ের কাজ। তবুও শঙ্কা কাটছে না। হু হু করে বাড়ছে সব ধরনের চালের দাম। নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্য দ্রব্যের পাশাপাশি বেড়েছে মোটা চালের দামও। কিছুটা নাগালে থাকা মোটা চালের দাম ছুঁয়েছে পঞ্চাশের কোটায়। এতে মহাবিপাকে পড়েছেন নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ।
পাঁচ-ছয়জনের একটি পরিবারে শুধু দু’বেলায় চালের খরচ যোগাতে হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এই খরচ যোগাতেই হিমশিম খাচ্ছেন তারা। নতুন বছরের শুরুতে মান ও প্রকারভেদে চালের দাম বেড়েছে প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। সাধারণ মানুষের দুঃসময়ে চালের দামের লাগাম টানতে বাজার মনিটরিংয়ের দাবি জানিয়েছেন ভোক্তারা। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাইস মিলমালিক ও মজুদদারদের ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণের কারণে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এজন্য উত্তরবঙ্গের রাইস মিল মালিক ও চালের করপোরেট কোম্পানিগুলোকে দায়ি করছেন তারা।
কুড়িগ্রামের বাসিন্দা মোরারক আলী বিভাগীয় নগরী রংপুরে এসে রিকশা চালান। থাকেন নগরীর চব্বিশ হাজারী এলাকায়। নিত্যদিনের মতো গত বুধবার রাত ৮টার দিকে বাড়ি ফেরার পথে কদমতলা বাজারে একটি মুদিদোকানে এসে জানতে চাইলেন, ‘মোটা চালের কেজি কত?’ দোকানদার উত্তর দিলেন, পুরোপুরি ৫০ টাকা। দাম কিছুটা কমানোর জন্য মোবারকের তোড়জোরের পরে তিনি বললেন, ‘ওএমএসের চাল খাও। সকালে ৩০ টাকায় পাবা।’
এসময় মোবারকের সঙ্গে কথা হলে প্রতিবেদককে জানান, বাবা-মা সন্তানসহ সাতজনের সংসারে প্রতিদিন গড়ে আড়াই কেজি চাল প্রয়োজন হয়। এজন্য প্রায় ১৫০ থেকে টাকা জোগাড় করতে খুবই কষ্ট হয় তার। সপ্তাহে দু-একবেলা না খেয়েই কাটাতে হয় তাদের। ভরা মৌসুমেই চালের বাজার অস্থির হওয়ার কারণে এ অঞ্চলের অধিকাংশ প্রান্তিক মানুষ চাপে রয়েছেন। বিশেষ করে দিনমজুর, রিকশা-ভ্যানচালকের মতো শ্রমজীবী মানুষ চরম বেকায়দায় পড়েছেন। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে শঙ্কা প্রকাশ করে তারা জানান, করোনার বিধি-নিষেধে তাদের আয় যেমন কমবে-তেমনি আরেক দফা বাড়বে চালসহ জিনিসপত্রের দাম।
সরেজমিনে রংপুর নগরীর সিটি বাজার, সিও বাজার, ধাপ, বুড়িরহাট, লালবাগ বাজার ঘুরে দেখা যায়, এসব বাজারে এখন স্বর্ণা ও গুটি স্বর্ণা জাতের মোটা চালের প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজিতে। আর সরু চালের মধ্যে মাঝারি মানের (মিনিকেট ও কাটারি) চালের দাম ৬২ থেকে ৬৫ টাকা। এর চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ভালো মানের সরু চাল (নাজিরশাইল ও জিরাশাইল) যা প্রতিকেজি ৬৮ থেকে ৭২ টাকা পর্যন্ত রাখা হচ্ছে। তবে ৫০ টাকা কেজির নিচে নিম্নমানের মোটা চাল কোনো বাজারেই মিলছে না।
নগরীর মাহিগঞ্জ এলাকার চালের আড়তদার চৌধুরী ট্রেডার্স’র পরিচালক মিলন শিকদার জানান, গত সপ্তাহে মিনিকেট চালের (৫০ কেজি) বস্তা ছিল তিন হাজার টাকা, যার বর্তমান বাজার মূল্য তিন হাজার ৫০০ টাকা। ব্রিধান-২৮ (৫০ কেজি) বস্তা ছিল দুই হাজার ৫০০ টাকা, বর্তমান বাজার মূল্য তিন হাজার টাকা। মোটা চালের মধ্যে গুটি স্বর্ণা (৫০ কেজি) বস্তা ছিল দুই হাজার ২০০ টাকা, যা বর্তমান বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৫০০ টাকা। চালের এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কারসাজি রয়েছে বলে মনে করছেন পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ছোট ছোট হাসকিং মিলগুলো এখন আর চলে না। বড় অটো রাইস মিল মালিকরা কম দামে ধান কিনে মজুদ করে নানা অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
মিল চাতাল মালিক, চাল ব্যবসায়ী, খুচরা বিক্রেতা ও কৃষকদের অভিযোগ, উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৬০০ অটোরাইস মিল মালিক নিজেদের ইচ্ছেমতো মজুদের পাহাড় গড়ে তুলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। আশঙ্কা প্রকাশ করে সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ অঞ্চলে রোপা আমন ধানের কাটামাড়াইয়ের পর শ্রমজীবি মানুষের হাতে কাজ থাকে না। তাদের সংসারে চলে টানাপোড়েন। তার ওপর চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।
রংপুরের মাহিগঞ্জসহ দিনাজপুরের পুলহাট, বগুড়া, নওগাঁ ও রাজশাহী থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক চাল ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। বৈরি আবহাওয়ার অজুহাতে এসব মোকামে কয়েকদিন থেকে অটোরাইস মিল মালিকরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকার এখনই যদি এই অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় তা হলে এই সিন্ডিকেট চালের বাজার আরো অস্থিতিশিল করে তুলবে।
রংপুরের আবু পাটোয়ারী, মহিদ চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন আড়তদার জানান, তারা বিভিন্ন মোকাম ঘুরেও অটোরাইস মিলগুলোর কারণে চাল সংগ্রহ করতে পারেননি। অটোরাইস মিলের মালিকরা বাজার থেকে এক তরফাভাবে ধান সংগ্রহ করে নিজেদের ইচ্ছেমতো চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা জানান, পুরো উত্তরাঞ্চলের হাতে গোনা ৫০০ থেকে ৬০০ জন বড় ব্যবসায়ী ও অটোরাইস মিল মালিক সারা দেশের চালের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। বড় ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাধ্য হয়ে তারা তাদের মিল চাতাল বন্ধ করে দিয়েছেন।
রংপুর চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম চালের দাম বৃদ্ধির জন্য সরাসরি অটোরাইস মিলগুলোকে দায়ি করে বলেন, তারা আগে থেকে ধানের মজুদ গড়ে তুলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে অটোরাইস মিলগুলোর সঙ্গে পাল্লাা দিতে না পেরে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা অসহায় হয়ে পড়েছে। অটোরাইস মিলগুলো মজুদের পাশাপাশি নানা অজুহাতে সব ধরণের চালের দামও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিলগেটে চালের দাম বাড়ানোসহ আগের তুলনায় এখন কম সরবরাহ করছেন চালকল মালিকরা। ফলে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এতে খুচরা পর্যায়ে বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হতে হচ্ছে। অন্যদিকে মিল মালিক ও আড়তদাররা বলছেন, কৃষক পর্যায়ে ধানের দাম বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ধানের দাম বেড়েছে মণপ্রতি সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের বড় মোকাম ও মিল পর্যায়ে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এখন এরই প্রভাব পড়েছে খুচরা ও পাইকারি বাজারে।
আনন্দবাজার/শহক