ঢাকা | শনিবার
২৫শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মহামারির অবসান ওমিক্রনে

মহামারির অবসান ওমিক্রনে

দক্ষিণ আফ্রিকার বতসোয়ানায় করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই আফ্রিকার অন্যান্য দেশসহ ইউরোপ ও এশিয়ায় তা হু হু করে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে বিভিন্ন দেশে ওমিক্রন শনাক্ত আর থেমে নেই। সপ্তাহ খানেক আগেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ওমিক্রনকে উদ্বেগজনক ধরন হিসেবে বর্ণনা করছিল। তাতে ওমিক্রনের বিস্তার নিয়ে গোটা বিশ্বে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। একের পর এক জারি হতে থাকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাসহ লকডাউনের মতো বিধিনিষেধ। ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক দেশে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

বিজ্ঞানীদের মতে, করোনার সর্বশেষ উদ্বেগজনক ধরন ওমিক্রন সবচেয়ে বেশিবার জিনগত রূপ বদল করা সংস্করণ। এর জিনগত রূপ পরিবর্তনের তালিকা এত দীর্ঘ যে কয়েকজন বিজ্ঞানী একে ‘ভয়াবহ’ আর ‘মারাত্মাক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বিজ্ঞানীদের এমন বর্ণনার প্রমাণও পাওয়া গেল বিভিন্ন দেশে এর সংক্রমণের গতি আর ভয়াবহতা দেখে। বিশেষ করে অতি-সংক্রামক ওমিক্রন ভারতের ২৩ রাজ্য ও ভূখণ্ডে হানা দিয়েছে। ওমিক্রন ঠেকাতে ইতোমধ্যে রাজধানী দিল্লি ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র মুম্বাইতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে কারফিউ জারি করেছে সরকার।

গত মঙ্গলবারই ভারতে ৩৭ হাজার ৩৭৯ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। যা এক সপ্তাহের ব্যবধানে অন্তত পাঁচগুণ। যাদের বেশিরভাগই ওমিক্রনে। এর আগেরদিন যুক্তরাষ্ট্রে একদিনে ১০ লাখের বেশি মানুষের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। অন্যদিকে, লক্ষণবিহীন তিনজনের শরীরে করোনা শনাক্ত হওয়ায় চীনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ১০ লাখ অধিবাসীর শহর ইউঝাউয়ে লকডাউন দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, বাংলাদেশেও ওমিক্রন বাড়িয়ে দিয়েছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ জরুরি সভা ডেকে ওমিক্রন ঠেকানোর নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছে। এর মধ্যেই রোগতত্ত্ব, রোগ নিরাময় ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন সতর্ক করে বলেছেন, আগামী তিন থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে দেশে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়তে পারে। তিনি আরো বলেছেন, ওমিক্রনের সংক্রমণ শক্তি বেশি হওয়ায় আরও বেশি সংখ্যক লোক আক্রান্ত হতে পারে। একইসঙ্গে ওমিক্রন ঠেকাতে সাতদিনের মধ্যেই বিধিনিষেধ জারি করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সুপারিশ করেছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ইতোমধ্যে ওমিক্রন ঠেকাতে ১৬ দফা নির্দেশনাও জারি করা হয়েছে।

তবে ভারত জুড়ে করোনার নুতন ধরন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করছেন ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের (আইএইচএমই) অধিকর্তা চিকিৎসক ক্রিস্টোফার মারে। সর্বভারতীয় এক সাংবাদমাধ্যমকে দেয়া তার একটি সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতি দিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা। সেখানে মারে বলছেন, করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গে ডেল্টার প্রভাবে যে ভাবে গোটা ভারত জুড়ে সংক্রমণ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছিল, এ বার ঠিক একই রকম ছবি দেখা যেতে পারে ওমিক্রনের কারণে। সাক্ষাৎকারে মারে আরো বলেছেন, আগামী দুই মাসের মধ্যেই বিশ্ব জুড়ে ৩০০ কোটি মানুষ ওমিক্রনে আক্রান্ত হবেন। আর ওমিক্রনের এই সার্জ বা তরঙ্গে ভারতেও বিপুল সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হবেন। ঠিক যেমনটা হয়েছিল ডেল্টার প্রভাবে। ওমিক্রনের প্রভাব চরমে পৌঁছবে জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে।

তবে বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতে সপ্তাহ খানেক পর অনেকটা ইতিবাচক তথ্য দিয়ে ডব্লিউএইচও মহাপরিচালক তেদরোস আধানম গেব্রেয়াসুস বললেন, মহামারির অবসান ঘটাতে পারে টিকা বণ্টনের ক্ষেত্রে সমতা। এ জন্য চলতি বছরের জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিটি দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে সব দেশকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। আর এটা করতে পারলে বর্তমান করোনা মহামারি অবসানের (শেষ) দিকে যেতে পারবে বিশ্ব। ওয়ান ক্যাম্পেইন নামে স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠনের টুইট শেয়ার করে এমন কথা বলেছেন ডব্লিউএইচও প্রধান।

যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ইমিউনোলজিস্ট মনিকা গান্ধী অবশ্য খানিকটা আশার বাণী শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমরা এখন সম্পূর্ণ আলাদা একটি পর্যায়ে রয়েছি। করোনাভাইরাস সব সময়ের জন্য আমাদের সঙ্গী হতে যাচ্ছে। তবে আমার আশা, নতুন ধরন ওমিক্রন আমাদের শরীরে অনেক প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করবে। যা এই মহামারির অবসান ঘটাবে। কয়েকটি গবেষণার তথ্যও এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, ওমিক্রনের কারণে নতুন করে করোনা শনাক্তে রেকর্ড হলেও রোগের তীব্রতা ও হাসপাতালে ভর্তির হার তেমন বাড়েনি। এটি মহামারি অবসানের ইঙ্গিত বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ বলছেন, এটা করোনা মহামারি নিয়ে চিন্তিত না হওয়ার নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

ডেল্টাসহ করোনার আগের কয়েকটি ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ওমিক্রন খুব বেশি মারাত্মক হবে না বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, কয়েকটি নিয়ামক এর পেছনে কাজ করছে। যেমন করোনার তীব্রতার একটি নিয়ামক হচ্ছে ফুসফুসকে সংক্রমিত করার সক্ষমতা। করোনার সংক্রমণ সাধারণত নাক থেকে শুরু হয়ে গলা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। হালকা সংক্রমণের ক্ষেত্রে শ্বাসতন্ত্রের ওপরের অংশের নিচে আর সংক্রমিত করে না। তবে করোনা আরও নিচে নেমে ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছলেই সাধারণত তীব্র লক্ষণগুলো দেখা দেয়। তবে ওমিক্রনের সক্ষমতা অনেকটাই কম।

হংকংয়ের একদল বিজ্ঞানী গবেষণার স্বার্থে অস্ত্রোপচারের সময় রোগীদের কাছ থেকে অল্প পরিমাণে ফুসফুসের টিস্যুর নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ওমিক্রন ওই নমুনা টিস্যুওগুলোর ওপর ধীর গতিতে বিস্তার লাভ করেছে। ওমিক্রনের প্রথম শনাক্ত অঞ্চল দক্ষিণ আফ্রিকার এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডেল্টার তৃতীয় ঢেউয়ের সময় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীরা যে পরিমাণ গুরুতর রোগে ভুগছিলেন, সেই তুলনায় ওমিক্রনের চতুর্থ ঢেউয়ে গুরুতর রোগ ও অসুস্থ হওয়ার সংখ্যা ৭৩ শতাংশ কম ছিল। অন্যদিকে, কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজিস্ট ওয়েন্ডি বার্গার্স বলছেন, হাসপাতালে ভর্তি ও গুরুতর অসুস্থ হওয়া যে কমে এসেছে, এ ব্যাপারে আগত তথ্য নির্ভরযোগ্য।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন