- মরুকরণে বিবর্ণ জনপদ-পরিবেশ
- তিস্তা যেদিকে, অভাব সেদিকে
এককালের স্রোতস্বিনী তিস্তা এখন মরা খালের মতো। মানুষের হাতে মৃত্যুই যেন তার নিয়তি। উজানে ভারত গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণ করে তিস্তার উচ্ছল দূর্বার গতিকে ঠেকিয়ে দিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ক্যানেলের মাধ্যমে নদীর স্রোত ঘুরিয়ে দিয়ে তার বুক থেকে তুলে নেওয়া টলটলে জল। জীবন হারিয়ে তাই মরতে শুরু করেছে এককালের প্রমত্তা তিস্তা। নদীপাড়ে দাঁড়ালেই বাতাসে ভেসে আসে ক্ষীণকায় তিস্তার দীর্ঘশ্বাস। গুঁমড়ে ওঠা কান্নার শব্দ। উজান থেকে ভাটিতে যেখানে এসে তিস্তা ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলেছে, এই তিনশ’ কিলোমিটার নদীকে ঘিরে দু’পাড়ের যেসব মানুষ গড়ে তুলেছিলো বসতি ও জীবিকা, প্রকৃতি এঁকেছিলো জলরঙে সবুজের ছবি; এখন তা ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে। বিপন্ন হয়ে পড়ছে পরিবেশ। মরুকরণ প্রক্রিয়া দ্রুততর হওয়ায় মরে যাচ্ছে বড় বড় গাছপালা। হারিয়ে যাচ্ছে জীব বৈচিত্র।
নীলফামারী জেলার ছাতনাই গ্রাম থেকে তিস্তা বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করেছে। সেখান থেকে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর পর্যন্ত যেখানে ব্রহ্মপুত্রে এসে মিলিত হয়েছে- এই দীর্ঘ পথ ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে তিস্তা তার নাব্যতা হরিয়ে হয়েছে শীর্ণ, কঙ্কালসার। হাজার হাজার পরিবার তিস্তার এ করুণ পরিণতিতে এখন পুরোপুরি বেকার। হারিয়ে গেছে রঙিন পালের নৌকা আর সেই চিরচেনা সুর-নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইল্যা…।
তিস্তাপারের প্রবীণদের স্মৃতিতে এখনও ভাসে বাড়ি থেকে একটু দূরে ছুটে চলেছে কাকচক্ষু জল তিস্তা সৌম্য, শান্ত কিন্তু উচ্ছল। গ্রামজুড়ে মানুষের মনে তখন ছিলো অনাবিল শান্তি। বড় বড় গাছপালা আর পাখিদের কলতানে মুখরিত থাকতো গোটা গ্রাম। আকাশে উড়তো শঙ্খ কিংবা হলুদ ডানার চিল। বট-পাকুড়ের ফল খাওয়ার জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে আসতো হরিয়াল পাখির দল। তাদের কলরবে ঘুম ভাঙতো গ্রামের মানুষজনের। সে ছিলো এক অন্যরকম সকালের অনুভূতি। আর এখন যতদুর চোখ যায় শুধু বালি আর বালি। তিস্তায় আর এখন দেখা যায় না ঘড়িয়াল কিংবা শুশুক। প্রবীণরা জানান, চৈত্রের শেষ দিকে নদীর মাছ উজানে যায় ডিম ছাড়ার জন্য। এখন নদীতে পানি না থাকায় মাছও বিলীন। এ কারণে মাছের বড়ই আকাল এখন তিস্তায়। তারা বলেন, তিস্তা নদীকে বাঁচাতে হলে এর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করতে হবে-এ জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়িয়ে তিস্তার অপর পারে এক সময়ের সমৃদ্ধ গ্রাম কলাগাছি। সময়ের ব্যবধানে এখন তা কলাগাছির চর। স্বাধীনতার পর এ গ্রামের পিছু নেয় তিস্তা। দু’বছরেই বিলীন হয়ে যায় পুরো গ্রাম। ওই গ্রামেরই অবস্থাসম্পন্ন কৃষক ছিলেন আব্দুর রশীদ। প্রায় ২০ একর আবাদী জমি তিস্তার বুকে হারিয়ে তিনি এখন পশ্চিম মহিপুর এলাকার বাঁধে বসবাস করছেন ছয় ছেলে-মেয়ে নিয়ে। তিনি বলেন, এখনও তিস্তার ভাঙন ঠেকানো গেলে হাজার হাজার পরিবারকে নিঃস্ব হওয়ার হাত থেকে বাঁচানো যাবে। কোলকোন্দ ইউনিয়নের তিস্তার অপর পারের গ্রাম বিনবিনার চরের এক সময়ের মধ্যবিত্ত কৃষক তৈয়ব আলী এখন গঙ্গাচড়া সদরে রিকশা চালান। নদী ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন। এ রকম হাজার হাজার অবস্থাসম্পন্ন বা মধ্যবিত্ত পরিবারকে নিঃস্ব করেছে সর্বগ্রাসী তিস্তা।
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা সদরের দোলাগান্না গ্রামে তিস্তার কোল ঘেঁষেই হাত দশেক দূরে ঝুঁপড়ি ঘর বকুলের। পঁচিশ বছরেই ১০ বার নতুন করে ঘর বেঁধেছেন তিনি। লক্ষ্মিটারী ইউনিয়নের শংকরদহ গ্রামের এককালের সবচেয়ে অবস্থাসম্পন্ন কৃষক সতীষ মাড়েয়ার ছেলে বকুল। চোখের সামনেই পরিবারকে সর্বস্বান্ত হতে দেখেছেন। কয়েক বছরেই নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে তাদের দু’শত বিঘা জমি। চোখের পলকেই বিলীন হয়েছে বাড়ি লাগোয়া প্রায় সাত বিঘা জমির সুপারী বাগান। এখন তিনি নিঃস্ব-দিনমজুর। তার মতো হাজারো পরিবার তিস্তার করাল গ্রাসের শিকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে বছরের পর বছর ধরে।
স্থানীয়রা বলেন, তিস্তা যেদিকে যায়, অভাবও সেদিকে ধায়। কয়েক কিলোমিটার প্রশস্ত অপেক্ষাকৃত শান্ত এ নদীটিই সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে বর্ষায়। গিলতে থাকে বসতবাড়ি, আবাদী জমি। চোখের পলকে বিলীন হয়ে যায় বিস্তীর্ণ জনপদ। এর সর্বগ্রাসী আচরণই আজ কূলবর্তী পাঁচ জেলার প্রায় ১০ লাখ মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। এ নদীর কারণেই কৃষিতে এককালের সমৃদ্ধ বৃহত্তর রংপুরের নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও রংপুরে প্রতিবছর দেখা দিতো ‘মঙ্গা’। তিস্তার ভাঙনে সর্বস্বান্ত এককালের সামন্ত গেরস্থ, বিশাল ব্যবসায়ী, জোতদার, মধ্যবিত্ত সবাই আজ এক কাঁতারে দাঁড়িয়েছে। সর্বগ্রাসী এ নদীর দু’পাশেই গড়ে উঠেছে ভূমিহীন হাজার হাজার পরিবারের নিবাস। নদীর বুকেই রয়েছে তাদের সবকিছু। বসতভিটে-আবাদী জমি, পুকুর, ক্ষেত-খামার, সুপারী বাগান। তিস্তার ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে এ মানুষগুলোই আজ হয়ে উঠেছেন নাঙ্গা-ভুখা, দিনমজুর, শ্রমজীবি। এরাই শ্রমের সন্ধানে ছুটে বেড়ান জেলা থেকে জেলায়। উত্তরের অভাবের পেছনে রয়েছে এই তিস্তার থাবা।
রংপুরে আট উপজেলা হলেও অভাব বার বার শুধু তিস্তার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এলাকাগুলোতেই দেখা দিচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তিস্তার ভাঙনকেই দায়ী করেছেন স্থানীয় লোকজন। তাদের মতে তিস্তার ভাঙনের কারণেই রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার হাজারো মানুষ আজ ভূমিহীন। বাঁধ বা সরকারি জমিতে ছোট ছোট ঘর তুলে বসবাস করছেন তারা। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত এসব মানুষের পেশা আজ দিনমজুরি। প্রতি বছর আশ্বিন-কার্তিক মাসে কাজের অভাব দেখা দিলে শুরু হয় প্রবল অভাব।
তিস্তার কারণে সৃষ্ট খরা ও বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শীত মৌসুমের আগেই নদীর বুকে জেগে ওঠে মাইলের পর মাইল চর। শুকনো মৌসুমে এর বিবর্ণ চেহারা। এ বছরও জেগে উঠেছে চর-ডুবোচর। নদীর নাব্যতা নেই। তিস্তার বুকে জেগে ওঠা ছোট-বড় চরগুলোতে এখন চলছে আলু, তামাক, রসুন, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ। তবে বর্ষা মৌসুমে তিস্তা হয়ে ওঠে প্রমত্তা। বেড়িয়ে আসে তার আসল রূপ। গ্রাস করতে থাকে মাইলের পর মাইল গ্রাম, ফসলি জমি, বিস্তীর্ণ জনপদ। নদী ভাঙনের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যেদিকে ইচ্ছা ভাঙতে থাকে। আবার অপর পাড়ে জেগে ওঠে চর। এ কারণে তিস্তাপারের মানুষ একে এক রকম ভালোবেসেই ‘পাগলা তিস্তা’ সম্বোধন করেন।
স্থানীয় লোকজন জানান, প্রতি বছর ভাঙন ঠেকাতে বিশাল জোগার-জন্তর করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। বাঁধ দেওয়া হচ্ছে, স্পার তৈরি হচ্ছে। বোল্ডার ফেলার বাজেট আসছে। ভরা মৌসুমে চলে বালুর বস্তা ফেলার মহড়া। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুতেই। পাউবো’র কোটি কোটি টাকার ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বছর গড়াতে না গড়াতেই নেওয়া হচ্ছে নতুন নতুন প্রকল্প। ঠিকাদাররা মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে ঘুরছেন বাঁধের পর বাঁধ। শ্রমিক নেওয়া হচ্ছে, কর্মকর্তারা ছুটছেন গাড়ি নিয়ে। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
প্রতি বছর তিস্তার ভাঙনে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। নদীর দু’ধারে বাঁধকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ভূমিহীন লাখ লাখ মানুষের বসতি। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চিকিৎসা-পরিবার পরিকল্পনা সবকিছু থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে তারা। গুণিতক হারে বাড়ছে ওই এলাকার জনসংখ্যা। বাড়ছে না ভূমি, তৈরি হচ্ছে না কর্মক্ষেত্র। স্বাধীনতার পর থেকেই তিস্তা বিধৌত এলাকার নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কোটি কোটি টন খাদ্যশস্য। রিলিফ বা ত্রাণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে অনেক কিছুই। অর্ধেক সেসব মানুষের হাতে পৌঁছে, বাকি অর্ধেক নিয়েও রয়েছে নানান অভিযোগ। তবে এতে হাজারো ভূমিহীন মানুষের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
একমাত্র রংপুর জেলাতেই তিন উপজেলার প্রায় চার লাখ মানুষ তিস্তার ভাঙনে সর্বস্বান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবেচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা গঙ্গাচড়া। এখানকার নয়টি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটিই নদী ভাঙন কবলিত। উপজেলার কোলকোন্দ, গঙ্গাচড়া, লক্ষ্মিটারী, গজঘণ্টা, মর্ণেয়া, আলমবিদিতর ও নোহালী ইউনিয়নের হাজার হাজার একর আবাদি জমি এখন নদীগর্ভে। এছাড়া কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, মধুপুর এবং পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ও তাম্বুলপুর ইউনিয়নের হাজার হাজার কৃষক পরিবারের জীবনে চরম অনিশ্চয়তা এনে নিয়েছে এই তিস্তা।
আনন্দবাজার/শহক




