ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে জীবন বদল ইসরাতের

প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে জীবন বদল ইসরাতের
  • বাহ, এতো চমৎকার ব্যাগ! বললেন প্রধানমন্ত্রী
  • একটি ছবিতেই ব্যবসার প্রসার

পাটমন্ত্রী ইসরাতের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আমি বিশ্বাস করি তুমি একদিন বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে।

রাজধানীতে শুরু হয়েছে জাতীয় এসএমই পণ্য মেলা। গত ৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া মেলায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৬০ ভাগই নারী উদ্যোক্তা। মেলার প্রথমদিনেই কথা হয় মিরপুরের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ইসরাত জাহানের সঙ্গে। তিনি শেখ ফজিলাতুন্নেসা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল। ২০১৮ সালে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছিলেন। তবে ততদিনে তার চাকরির বয়সও শেষ হয়ে গেছে। লাখো তরুণ চাকরিপ্রার্থীর ভিড়ে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি কোথাও। তিনি আনন্দবাজারকে বলেন, অনেকেই টিপ্পনি কেটে বলতেন, আপনার তো এখন অবসরের সময় হয়ে গেছে। তবে দমে যাবার পাত্র নন ইসরাত। নতুন কোনো ব্যবসার চিন্তা করতে থাকেন। সেই সময় পাটের তৈরি পণ্য উৎপাদনের বিষয়টি জানতে পারেন।

পরিবারের অনুপ্রেরণায় পরে বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) থেকে জুন মাসে কোর্স করেন। ট্রেনিং শেষে সার্টিফিকেট পাওয়ার পরদিনই একটি মেশিন কেনেন। মিরপুর ১৪ নম্বরে কারখানা স্থাপন করেন। এরপর থেকেই ঘুরে যায় জীবনের মোড়। মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে অংশ নেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায়। যদিও মেলায় অংশ নেয়া মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। তবে মেলা থেকে লাভ নিয়েই ফিরেছিলেন ইসরাত। বিক্রির জন্য শার্টের আদলে কলার টাই ব্যাগ ছিল নতুন ভাবনা। যা বদলে দিয়েছে সবকিছু।

পরবর্তীতে ২০১৯ সালের জাতীয় পাট মেলায় পাটের তৈরি অভিনব ব্যাগটি প্রধানমন্ত্রীর নজরে পড়ে। ব্যাগটি পছন্দ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছবি তোলেন এবং ছবিটি ইসরাতকে দেয়ার জন্য স্টাফদের বলে দেন। বেশ কিছুক্ষণ স্টলে অবস্থান করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রথমে সরকারপ্রধান ভেবেছিলেন এটা একটি শার্ট। পরে এটা ব্যাগ বলার পর প্রধানমন্ত্রী দারুণ খুশি হয়ে বলেছিলেন, বাহ এতো চমৎকার ব্যাগ! উপস্থিত সবাইকে প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাগটি দেখিয়েছিলেন। কীভাবে এ আইডিয়া এলো সে ব্যাপারে প্রশ্ন ছিল প্রধানমন্ত্রীর। মেলায় সবাইতো ব্যাগ তৈরি করে, কিন্তু সে ব্যাগের মধ্যেও নতুন কিছু করার তাগিদ থেকেই চমৎকার এ উদ্ভাবন ছিল ইসরাতের। প্রথমে একটু ভয় ছিল ব্যাগটি দেখে মানুষ হয়তো হাসবে। তবে মানুষ যে এতো বেশি সাড়া দেবে তা চিন্তার বাইরে ছিল। প্রধানমন্ত্রী তখনই নতুন নতুন পণ্য নিয়ে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই সর্বদা নতুন পণ্যের একটা ভাবনা চেপে বসে ইসরাতের মাথায়।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গের সেই ছবিটি বদলে দেয় ইসরাতের ব্যবসায়িক জীবন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি এ নারী উদ্যোক্তাকে। এ ছবির মাধ্যমে ইসরাতের পরিচিতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ ব্যবসায় পরিচিতি একটি বড় বিষয় বলে মনে করেন ইসরাত। তা না হলে মাত্র ৪ বছরে কেউ এতো পরিচিতি পায় না বলে জানান তিনি। এরপর একের পর এক নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করেন ইসরাত। দেশে-বিদেশে ভ্রমণের সময় ট্রলি ব্যাগের বহুল ব্যবহার সর্বত্র দেখা যায়। এ ট্রলি ব্যাগ পাট দিয়ে তৈরি করার পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু কোনো কারিগর এ কাজ করতে রাজি হচ্ছিলেন না। এটা সম্ভব নয় বলে জানার কারখানায় কর্মরত কারিগররা। তবে হাল ছেড়ে দেননি ইসরাত। অনেক চেষ্টার পর একটা স্যাম্পল কপি তৈরি করেন। ২০২০ সালে অফিসার্স ক্লাবে আয়োজিত পাট মেলায় এ স্যাম্পলটি নিয়ে হাজির হন। সে মেলায় বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর চোখে পড়ে ট্রলিটি। তখন এ নতুনত্ব দেখে মন্ত্রী ইসরাতের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি তুমি একদিন বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে।’

সরকারের উচ্চপর্যায়ের লোকদের প্রশংসা ইসরাতকে দারুণভাবে উৎসাহিত এবং প্রভাবিত করে। এখন প্রতিনিয়িত পাট নিয়ে নতুন কিছু করা কিংবা পণ্যে ডাইভারসিফিকেশন আনার চেষ্টা চেষ্টা করেন। ইসরাতের বেশিরভাগ পণ্য দেশের বাইরে যাচ্ছে। শুধু ফেসবুকের মাধ্যমেই মার্কেটিং করছেন তিনি। ফেসবুকের পোস্ট থেকেই অর্ডার আসে। আর দেশের বাইরের কোনো অর্ডার থাকলে জেডিপিসির মেম্বার হিসেবে কর্তৃপক্ষ ইসরাতের নাম্বার দিয়ে দেয়।

ইসরাতের ব্যবসায়ে প্রথম অর্ডার ছিল যুক্তরাজ্যে তিন হাজার পিস টোট ব্যাগ আর শপিং ব্যাগ ডেলিভারি দেয়া। এখন মাসে ৮ লাখ টাকারও বেশি বিক্রি হয়ে থাকে। ১৬টি মেশিন নিয়ে কাজ করছেন তিনি। যেখানে নিয়মিত ৫ জন এবং অনিয়মিত ১৬ থেকে ১৭ জনের কর্মস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। দেশের বাইরে বিশাল মার্কেটে প্রতিনিয়ত চাহিদা বেড়েই চলছে। মানুষ পরিবেশ সচেতন হয়ে পাট পণ্যের প্রতি ঝুঁকে পড়ায় এ খাতে রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা।

নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হয় বলে জানান ইসরাত। মার্কিটিংয়ের জন্য আরো নতুন কিছু করার কথা ভাবছেন তিনি। কাস্টামারের সঙ্গে অর্ডাল নিয়ে কাজ করার জন্য লোক নিয়োগ দিবেন। অনেকে বায়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে কম মূল্যে অর্ডার নিয়ে মার্কেট প্রাইজ কমিয়ে দেন। অর্ডার বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। নতুনদের অনেকে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার চেষ্টা করে থাকে বলে তার অভিযোগ। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রচার-প্রসার, বিক্রি ও বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যেই নবম বারের মতো শুরু হয়েছে এসএমই পণ্য মেলা। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘নবম জাতীয় এসএমই পণ্য মেলা ২০২১’-এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নতুনত্ব, কাজের কমিটমেন্ট আর পণ্যের মান নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন ইসরাত জাহান। প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই চাকরির পেছনে না ঘুরে উদ্যোক্তা হওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ইসরাতের চাকরি না পেয়ে উদ্যোক্তা হয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির গল্গের মতো অনেক গল্প এখন এক নতুন বাস্তবতা। যার ওপর ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি আর দেশ ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে মধ্যম আয়ের দিকে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন