শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নতুন দিগন্তে রেলওয়ে

‘কু ঝিক ঝিক’ রেলগাড়ি বা ধোঁয়া ছেড়ে হুস হুস করে ছুটে চলা কয়লা ইঞ্জিনের দিন পেরিয়েছে কয়েক দশক আগে। বহু আগেই দেশের রেলওয়ে আধুনিকতার ছোঁয়াও পেয়েছে। এরপর প্রতিদিনই কিছু না কিছু নতুনত্বের ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের রেল যোগাযোগ তথা বাংলাদেশ রেলওয়ে। গেল পঞ্চাশ বছরে রেলওয়ের ইতিহাসই বদলে গেছে। রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে নতুন এক সমৃদ্ধ ইতিহাস।

উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৮৬২ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রেল কোম্পানি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে ছোট ছোট রেলপথ সেকশন চালু করতে থাকে। প্রথমদিকে অর্থনৈতিক কাজের জন্য রেলপথ চালু করা হয়। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি প্রথমে এদেশে রেলপথ স্থাপন করে। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে এই অঞ্চল রেল যুগে প্রবেশ করে।

ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন আমাকে

ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি কোলকাতা থেকে রানাঘাট পর্যন্ত ব্রড-গেজ রেলপথ সেকশনটিকে ১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর এবং রানাঘাট থেকে দর্শনা হয়ে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেলপথ সেকশনটিকে ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর চালু করে। গোয়ালন্দ পর্যন্ত সেকশনটি চালু হয় ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি। ১৮৭৪-১৮৭৯ সাল পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার জন্য শিলিগুড়ি পর্যন্ত সেকশনটি নর্দান বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে মিটার-গেজে চালু করে। পার্বতীপুর থেকে দিনাজপুর এবং পার্বতীপুর থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত মিটার-গেজ সেকশনটিও এই কোম্পানি চালু করে। ১৮৮৪ সালের ১ জুলাই ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে আসে। এরপর ১৮৮৭ সালের ১ এপ্রিল তা নর্দান বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ের সঙ্গে একীভূত হয়।

স্বাধীনতার ৫০ বছর————— পর্ব-১

স্বাধীনতার ৫০ বছর————— পর্ব-২

ঢাকা স্টেট রেলওয়ে নামক একটি ছোট কোম্পানি ১৮৮২-১৮৮৪ সালে দমদম জংশন থেকে খুলনা পর্যন্ত প্রায় ২০৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রড-গেজ সেকশনটি চালু করে। ১৯০৪ সালের ১ এপ্রিল এটি ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে আসে। ব্রহ্মপুত্র–সুলতানপুর রেলওয়ে ব্রাঞ্চ নামক একটি কোম্পানি ১৮৯৯-১৯০০ সালে সান্তাহার জংশন থেকে ফুলছড়ি পর্যন্ত মিটার-গেজ সেকশনটি চালু করে।

আরও পড়ুনঃ  ব্রিকস সম্মেলনে শেষে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী

এই কোম্পানিও ১৯০৪ সালের ১ এপ্রিল ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে আসে। ১৯০৫ সালে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ কাউনিয়া–বোনারপাড়া মিটার-গেজ সেকশনটি চালু হয়। ১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারি, হার্ডিঞ্জ ব্রিজসহ ভেড়ামারা–শাকোলে সেকশন চালু হয়।
১৯১৪ সালে শাকোলে থেকে সান্তাহার পর্যন্ত মিটার-গেজ সেকশনটিকে ব্রড-গেজে রূপান্তরিত করা হয় এবং ১৯২৪ সালে সান্তাহার থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত প্রায় ৯৬ কিলোমিটার সেকশনটিকে মিটার-গেজ থেকে ব্রড-গেজে রূপান্তরিত করা হয়। ১৯২৬ সালে পার্বতীপুর থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত প্রায় ১৩৭ কিলোমিটার মিটার-গেজ সেকশনটিকে ব্রড-গেজে রূপান্তরিত করা হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর এদেশের রেলওয়ের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। যা উত্তরাধিকার সূত্রে পায় ২৮৫৮.৭৩ কিলোমিটার রেলপথ ও ৪৬৬টি স্টেশন। গেল ১৯৮২ সালের ৩ জুন রেলওয়ে বোর্ড বিলুপ্ত হয়ে এর কার্যক্রম যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের রেলওয়ে বিভাগের ওপর ন্যস্ত করা হয়। প্রথমবারের মতো রেলে স্থাপন করা হয় ভ্রাম্যমাণ রেল যাদুঘর। যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ রেল যাদুঘর হিসেবে নাম দেয়া হয়। এই যাদুঘরটি নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী।

প্রায় দেড় বছর ধরে এই যাদুঘরটি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় ১০০ ফুট লম্বা একটি ব্রডগেজ ও একটি মিটার গেজ কোচে অত্যাধুনিক প্রযূক্তিতে এই যাদুঘরটি সাজানো হয়েছে। এখানকার ডিজিটাল টাচ স্ক্রিনে ১৯২০ থেকে ১৯৭৫ সাল অবধি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক জীবন, মুক্তিযুদ্ধ, সংগ্রামী ইতিহাস, প্রদর্শিত হয়েছে। যা থেকে রেল ভ্রমণকারী, সাধারণ মানুষ ও আগামী প্রজন্মের শিশু-কিশোরেরা সহজেই জানতে পারবেন বঙ্গবন্ধু ও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে।

রেলওয়ে মহাপরিচালক ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের পর এটি শুধু বড় বড় রেল স্টেশনেই নয়, দেশের সব রেলওয়ে স্টেশনে ধারাবাহিকভাবে নির্ধারিত দিনে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্তভাবে দাঁড়ানো থাকবে। রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজনের মতে রেলওয়ের জন্য এটি একটি নতুন ইতিহাস। একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি এই যাদুঘরে তুলে ধরা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর শহীদ হওয়া ও সংগ্রামী জীবন, যা দেখে আমাদের আগামী প্রজন্ম মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হবে। রেলপথ সচিব সেলিম রেজা বলেন, এই যাদুঘর আমাদের গৌরব ও অংহকারের। এটিকে প্রান্তিক মানুষের কাছে নিয়ে যাবো।

বর্তমানে রেলের সব ধরনের যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। প্রতি বছর ব্যয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এমন অবস্থায় দেশেই বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সে লক্ষ্যে সৈয়দপুর রেল কারখানার ভেতরে ইতোমধ্যে ২০ একর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। ইঞ্জিন-কোচ মেরামতে আমদানি যন্ত্রাংশের বিকল্প উৎস সৃষ্টির জন্য প্রণায়ন করা হচ্ছে নীতিমালা। নীতিমালা চূড়ান্ত হলে দেশেই নতুন কোচ তৈরি হবে। ইঞ্জিন মেরামতে আমদানি যন্ত্রাংশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। এমন কথা বললেন রেলপথ সচিব সেলিম রেজা।

আরও পড়ুনঃ  জোয়ারে লেনদেন হাজার কোটিতে

রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী বলেন, নীতিমালা চূড়ান্ত হলে রেলখাতে আমূল পরিবর্তন ঘটবে। উপকৃত হবেন দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তারা। ইতোমধ্যে নতুন কারখানা বিষয়ে প্রাথমিক সমীক্ষা শুরু হয়েছে। ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষে কাযক্রম শুরু হবে। এটি হবে দেশের অন্যতম একটি মেগা প্রকল্প। রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন আশা করছেন রেলের ইঞ্জিন কোচসহ সব যন্ত্রাংশ শিগগিরই দেশে তৈরি হবে।

সূত্রমতে, বর্তমানে দেশে প্রায় ৭০০ নতুন কোচ সমন্বয়ে ট্রেন চলছে। আরো প্রায় ৪০০ কোচ অচিরেই যুক্ত হবে। যাত্রীবাহী কোচ পরিষ্কার করার জন্য কমলাপুর ও রাজশাহীতে স্থাপন করা হয়েছে দুটি স্বয়ংক্রিয় ওয়াশিং প্লান্ট। গত ৭ নভেম্বর কমলাপুর ওয়াশিং প্লান্টটির উদ্বোধন করেন রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন। এতে এখন মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০টি যাত্রীবাহী কোচ পরিষ্কার করা সম্ভব হবে। এতোদিন ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে এক গাড়ি পরিষ্কার করতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগতো। এখন মাত্র ৬ মিনিটের মধ্যে তা পরিষ্কার করা সম্ভব হবে। সাশ্রয় হবে প্রতিদিন কমপক্ষে এক লাখ লিটার পানির। দীর্ঘ সময় ধরে বাসে ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করতে এবার ভ্রমণপিয়াসীদের জন্য চালু হতে যাচ্ছে বিলাসবহুল ট্রেন। মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টায় যাওয়া যাবে ঢাকা থেকে কক্সবাজার। ইতোমধ্যে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনের কাজ ৬০ ভাগ শেষ হয়েছে।

কক্সবাজারকে আধুনিক টুরিস্ট নগরী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার ২০১৮ সালের মাঝামাঝি চট্টগ্রাম দোহাজারী থেকে কক্সবাজার, ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনের নির্মাণকাজ শুরু করে। এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি। এটি সম্পন্ন হলে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে টুরিস্ট নগরী কক্সবাজারের সুবিধা আরো বাড়বে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  দরপতনে ৭০ ভাগ প্রতিষ্ঠান

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন