ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে কি আইন অকেজো

মূলত চাহিদা ও যোগানে ভারসাম্যহীনতার কারণে বাজার অস্থির হয়। আবার মাঝে মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলেও তার প্রভাব পড়ে স্থানীয় বাজারে। কোনো কোনো সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে শস্যের ক্ষতি হলেও তার চাপ পড়ে দ্রব্যের বাজারমূল্যে।

কিন্তু বাংলাদেশের পণ্যবাজার অস্থির করছে ব্যবসায়ীদের (আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ী) আচরণ। কখনো নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট করে, কখনো রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার সুবিধা নিয়ে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছেন তারা। যদিও বাজার নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট আইন আছে। কোন পণ্য কতদিন মজুদ করা যাবে, সে বিধানও আছে। বাজার স্বাভাবিক করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাত্ক্ষণিক নানা সিদ্ধান্তও নেয়া হয়, যার বেশির ভাগ যায় বড় ব্যবসায়ীদের অনুকূলে।

যদিও দেশে বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতা আইন রয়েছে । এ আইনের তৃতীয় অধ্যায়ে বলা আছে, পণ্য বা সেবার ক্রয়-বিক্রয় মূল্য অস্বাভাবিকভাবে নির্ধারণ করলে; উৎপাদন, সরবরাহ, বাজার সীমিত করলে তা প্রতিযোগিতার পরিপন্থী বলে গণ্য হবে।

এছাড়া খাদ্যশস্য ও খাদ্যসামগ্রী মজুদের পরিমাণ ও মেয়াদ নির্ধারণ করে ২০১১ সালের মে মাসে আদেশ জারি করে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। এতে চাল, গম ও গমজাত দ্রব্য ছাড়াও ভোজ্যতেল (সয়াবিন ও পামঅয়েল), চিনি ও ডালকে খাদ্যসামগ্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ব্যবসায়ী পর্যায়ে পাইকারি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ধান ও চাল মজুদের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৩০০ টন ও মেয়াদ ৩০ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। খুচরা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ১৫ দিন মজুদ করা যাবে। আর মজুদের পরিমাণ হবে সর্বোচ্চ ১৫ টন।

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারী চর্চাগুলো নির্মূল করার পাশাপাশি বর্তমান পরিস্থিতিগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। কোনো ব্যবসায়ী কারসাজি করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোথাও কোনোভাবে মনোপলি কিংবা সিন্ডিকেট দেখলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মাস দেড়েক ধরে পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক করায় ব্যস্ত রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা। এর মধ্যেই বাড়তে থাকে চালের দামও। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে পণ্যটির দাম কেজিপ্রতি ৫-৮ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

চালের বাজার মূলত মজুদ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। মিলারদের কাছে যেখানে প্রায় ৯৭ লাখ টন চালের মজুদ ক্ষমতা রয়েছে, সেখানে সরকারের আছে মাত্র ২১ লাখ টন। ফলে চালের বাজারে অঘোষিত নিয়ন্ত্রক এখন মিলাররা। কুষ্টিয়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুরের ১২-১৫টি বড় মিলারই মূলত চালের বাজারের নিয়ন্ত্রক।

গুটিকয় মিলারের হাতে চালের বাজার নিয়ন্ত্রিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি ও কুষ্টিয়ার রশিদ অ্যাগ্রো ফুড প্রডাক্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রশিদ বলেন, যে দামে ধান পাওয়া যায়, সে অনুযায়ী চালের দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করা হয়। ধানের দামে এবং বিপণন ব্যবস্থায় পরিবর্তন হলেই কেবল দামের পরিবর্তন হয়। কখনই বাড়তি মজুদ বা জিম্মি করে দাম বাড়ানো হয় না। আমাদের ব্যবসায় সিন্ডিকেটের কোনো প্রশ্নই আসে না। দেশের মানুষের মুখে ভাত তুলে দেয়াকে আমরা দায়িত্ব মনে করি।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. মো. আসাদুজ্জামান মনে করেন, রাষ্ট্র দক্ষভাবে ব্যবসায়ীদের তদারক করতে না পারায় বাজার অস্থির হচ্ছে। তিনি বলেন, কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে বাজার সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। আবার তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থাও নেয়া যাচ্ছে না। এগুলোর মানেই হলো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় দুর্বলতা আছে। কোন ব্যবসা কারা নিয়ন্ত্রণ করছে তা কিন্তু মন্ত্রণালয়গুলো বা কর্তৃপক্ষ কারোরই অজানা নয়। তার পরও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আবার পণ্য আমদানির লাইসেন্সগুলো সব এক অঞ্চলকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা তো সিন্ডিকেট করবেই। তাই কর্তৃপক্ষকে এখনই বুদ্ধিভিত্তিক কার্যক্রম বাড়াতে হবে।

তবে ভোগ্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক রাখতে রাষ্ট্রের তরফ থেকে সম্ভাব্য সবকিছুই করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অনেক সময় পণ্য নিয়ে অপপ্রচার চালানো হয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ নেন। এর দায় এককভাবে কারো নয়, এর দায় সবার।

আনন্দবাজার/ইউএসএস

সংবাদটি শেয়ার করুন