এখন শুধু বিনোদন ও সংবাদ জানতেই নয়, তথ্যের আদান-প্রদান, প্রচারমাধ্যমসহ জীবনযাত্রায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি অনুষঙ্গ হিসেবেই জায়গা দখল করে নিয়েছে টেলিভিশন (টিভি)। দেশে মোট ইলেকট্রনিকস যন্ত্রের ৩৫ শতাংশই দখল করে আছে টেলিভিশন। দাম কমায় এখন উ”চ প্রযুক্তির টিভিও গ্রামে প্রতিটি ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। ন্যূনতম একটি তো অবশ্যই, কোনো কোনো ঘরে এখন একাধিক টিভিও রয়েছে। এ ছাড়া পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকান থেকে করপোরেট অফিস, হাসপাতাল থেকে বিপণিবিতান, স্টেশন থেকে বন্দর—সবখানেই টিভির ব্যবহার। টিভিতে বিনোদনের পাশাপাশি ক্লাস, জুম মিটিং, ইন্টারনেট ব্রাউজিংসহ যাপিত জীবনের অনেক কাজই সারা যাচ্ছে। রাস্তার পাশে বিজ্ঞাপনী বুথ, ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা মনিটর, বাস, রেল, বিমানে প্রয়োজনীয় নির্দেশনায়, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রচারণায় টিভির ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয় হয়ে আছে। আর এতে প্রতিবছর বিক্রি বাড়ছে, যদিও করোনা মহামারিতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে।
উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে টিভি বিক্রি বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। বছরে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টিভির চাহিদা রয়েছে শুধু দেশেই। এই চাহিদার ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশই উৎপাদন করছে দেশীয় কম্পানিগুলো। বাকি ৩০ শতাংশ বৈশ্বিক কম্পানিগুলোর দখলে রয়েছে। উৎপাদকদের হিসাবে দেশে বার্ষিক টিভির বাজার তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকার। এ ছাড়া রফতানিও হচ্ছে ৩৫টি দেশে। দেশের বড় কয়েকটি কম্পানি এখন দেশীয় বাজারের চেয়ে রফতানির বাজারের দিকেই মনোযোগ দিয়েছে বেশি। র্যাংগস ইলেকট্রনিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জে একরাম হোসেন বলেন, মোবাইল, ল্যাপটপের ব্যবহার বেড়েছে। বেড়েছে এগুলোর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারও। এতে মনে হতে পারে টেলিভিশনের ব্যবহার কমে যাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয় বরং বাড়ছে। আগে হয়তো বাসাবাড়িতে একটি টিভি থাকত, এখন একাধিক থাকে। ভবিষ্যতে একই বাড়িতে বিভিন্ন কাজে প্রতিটি ঘরেই টিভি থাকবে। এ ছাড়া ঘরের বাইরে রাস্তাঘাটে, সচেতনতা বাড়াতে, বিজ্ঞাপন প্রচারে, অফিসে, যানবাহনে টিভির ব্যবহার আরো বাড়বে। ফলে এ খাতের প্রবৃদ্ধি হবেই। তবে ফিচারে পরিবর্তন হবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপডেট হবে, গ্রাহকের রুচি ও চাহিদা অনুসারে সংযোজন-বিয়োজন হবে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে ওয়ালটনসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান টিভি রফতানি করছে। এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপের ৪০টিরও বেশি দেশে টিভি রফতানি হচ্ছে বলে জানা যায়। ইউরোপের বাজারে বড় রফতানিকারক হলো দেশীয় ব্র্যান্ড ওয়ালটন। ওয়ালটনের মোট টিভি রফতানির ৯০ শতাংশেরও বেশি যাচ্ছে ইউরোপে। ইউরোপে দুই বছর আগে টিভি রফতানি শুরু করে ওয়ালটন। ইউরোপের নামিদামি গ্লোবাল ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে অল্প সময়ের মধ্যে ইউরোপের দেশে টিভি রফতানি কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছে ওয়ালটন।
ওয়ালটন টিভির চিফ বিজনেস অফিসার প্রকৌশলী মোস্তফা নাহিদ হোসেন বলেন, ‘ইউরোপের বাজারে ওয়ালটনের তৈরি টিভি রফতানি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক টেলিভিশনের চাহিদা ৯.৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এর পরও ইউরোপের জার্মানি, পোল্যান্ড, গ্রিস, স্পেন, ক্রোয়েশিয়ার মতো উন্নত বিশ্বের বাজারে টিভির রফতানি বাজার সম্প্রসারণে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে দেশীয় ব্র্যান্ড। ইউরোপীয় ক্রেতারা উ”চ মানের পণ্য উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশের ওপর আস্থা রাখছে। ফলে ইউরোপ থেকে ব্যাপক রফতানি আদেশ পাচ্ছি আমরা।’ ইলেকট্রো মার্ট (কনকা টেলিভিশন) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূরুল আফসার, টেলিভিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কম্পোনেন্ট হচ্ছে প্যানেল, যা এখনো বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে না। তবে সরকারের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে প্যানেলসহ সম্পূর্ণ টেলিভিশন বাংলাদেশ উৎপাদন করা সম্ভব। প্যানেলের চাহিদা আপাতত আমদানি করেই মেটানো হচ্ছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, টিভির বাজারে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের ইলেকট্রনিকসের বাজার আরো অনেক বড় হবে, সঙ্গে সঙ্গে টিভির বাজারও। অনেক সুযোগ রয়েছে এ খাতে। তবে এর জন্য কিছু নীতি সহায়তা দিতে হবে। দেশে মোটরসাইকেলশিল্পের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। এভাবে ইলেকট্রনিকস বা টেলিভিশনশিল্পের জন্যও একটি নীতি করা দরকার। এতে দেশীয় শিল্প আরো শক্তিশালী হবে। আধুনিক টেকনোলজিগুলো আসবে, কর্মীদের দক্ষতাও বাড়বে।
বিভিন্ন উৎপাদক কম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের বাজারের জন্য টিভি উৎপাদনে সর্বাগ্রে যে বিষয়টি তাঁরা মাথায় রাখেন, তা হলো দাম। দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে তাঁরা টিভি তৈরি করে থাকেন। কারণ দেশের মানুষ এখনো হাই ভ্যালু বা উ”চমূল্যের বড় স্ক্রিনের টিভি কেনায় তেমন অভ্যস্ত নয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারে ১৫ থেকে ২০টি মডেলের টিভি রয়েছে। এখনো ৯ থেকে ১০ হাজার টাকার টিভিই বেশি চলে দেশের বাজারে। দামের পর বিক্রয়োত্তর সেবায় গুরুত্ব দেন তাঁরা। দেশের বাজারে বর্তমানে এলইডি টিভির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। তবে রফতানিমুখী দেশীয় টেলিভিশনশিল্পের বিকাশে এখন বড় বাধা বা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় গ্রে মার্কেট। অর্থাৎ এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে ভ্যাট, ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে বিদেশ থেকে টিভি আমদানি করে স্থানীয় বাজারে কম দামে বিক্রি করছে। এসব টিভির মান খুবই নিম্ন। এদিকে গ্রে মার্কেট থেকে কম দামে নিম্নমানের টিভি কিনে ঠকছেন ক্রেতারা। অন্যদিকে দ্রুত বিকশিত দেশীয় টেলিভিশনশিল্পের অগ্রগতিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই কাস্টমস, শুল্ক বিভাগসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার কাছে এ খাতের দেশীয় উদ্যোক্তাদের দাবি—দেশের গ্রে মার্কেটে টেলিভিশন বেচাকেনা বন্ধে তারা যেন দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়। অন্যথায় মুখ থুবড়ে পড়বে দ্রুত বিকশিত ব্যাপক সম্ভাবনাময় রফতানিমুখী এই শিল্প।
আনন্দবাজার/শহক