দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদলে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে পৃথিবীর ১১তম দীর্ঘ পদ্মা সেতু। এই সেতু ঘিরেই যেমন সোনালি ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছেন ২১ জেলার মানুষ তেমনি এর মাধ্যমেই বাংলাদেশ যুক্ত হতে পারবে এশিয়ান হাইওয়েতে।
ফলে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি নতুন করে গড়ে উঠবে ভারী শিল্প-কারখানা। নতুন এক শিল্পবিপ্লবের সূচনা হবে। পায়রা বন্দর, কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতসহ দুই তীরে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক জোনগুলোকে কেন্দ্র করে নতুন মাত্রা পাবে দেশের পর্যটন খাত। এতে কর্মসংস্থানও বেড়ে যাবে বহুগুণ।
ইতোমধ্যে ঢাকা-বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের দুই পাশে তোড়জোর চলছে অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজ নিয়ে। বিশেষ করে দপদপিয়া, বিমানবন্দর, গড়িয়ার পাড়, শিকারপুর এলাকায় মহাসড়কের দুপাশে বেসরকারি খাতে অবকাঠামো উন্নয়ন চলছে একের পর এক। আর কলাপাড়া ছাড়িয়ে কুয়াকাটাসংলগ্ন সড়কে সাইনবোর্ডের যেন শেষ নেই। আর এ সবই হচ্ছে পদ্মা সেতুকে টার্গেট করে। শুধু তাই নয়, পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। যাতে মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) এক থেকে দেড় শতাংশ বাড়বে। দারিদ্র্যের হার কমবে দশমিক ৮৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য ও বিএম কলেজের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. আখতারুজ্জামান খান বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের বিনিয়োগ ব্যবস্থার দ্বার খুলে দিয়েছে। সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থান। পদ্মা সেতুকে ঘিরে এ অঞ্চলের মৎস্য, কৃষি, পর্যটন, অকাঠামো, ব্লু ইকোনমিসহ সব খাতের প্রসার ঘটবে। পায়রা বন্দরের আমদানি-রফতানির প্রভাব বরিশালের মানুষের ওপর পড়বে। পায়রা তাপবিদ্যুৎ ও ভোলার গ্যাস এ উন্নয়নকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নেবে।
অর্থনীতিবিদ আক্তারুজ্জামান আরো বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য এরই মধ্যে উদ্যোক্তাদের মধ্যে নীরব প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। পদ্মা থেকে পায়রা পর্যন্ত দুপাশে বিনিয়োগের গোল্ডেন লাইন সৃষ্টি হচ্ছে। তারমতে, বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলে এক ভাগ প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাবে। এতে সারা দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে শূন্য দশমিক ৬ ভাগ। তবে এক্ষেত্রে এখনই বৃহৎ পরিকল্পনা ও পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর প্রাক্কলন অনুযায়ী পদ্মা সেতু দেশে প্রতিবছর ১.৯ শতাংশ হারে দারিদ্র্য হ্রাসে ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার ৩১ বছরের মধ্যে জিডিপি ৬০০০ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পাবে এবং ২০৩২ সালের পর বাৎসরিক রিটার্ন ৩০০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি উপকূলীয় জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ শক্তিশালী হবে বা অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হবে। ফলে ওই অঞ্চলের কৃষি, যোগাযোগ, শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও জীবনমান বৃদ্ধি পাবে; যা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ঘটাবে।
এছাড়া পদ্মা সেতু চালু হলে দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে ১.২ শতাংশ হারে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। পদ্মা সেতু ও উভয় পারের পর্যটন থেকেই প্রতিবছর কয়েকশ’ কোটি টাকা আয় হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণকালীন নদীশাসনের ফলে ১৫৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের ৯ হাজার হেক্টর জমি নদীভাঙন থেকে রেহাই পাবে। পাশাপাশি বন্যার কবল থেকেও রক্ষা পাবে কয়েক লাখ মানুষ।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে চালু রাখা ফেরি সার্ভিসের প্রয়োজন ফুরাবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ায় এ সেতু থেকে আদায় করা টোল সম্পূর্ণরূপে সরকার পাবে। ফলে প্রতিবছর সরকারের আয় বাড়বে প্রায় ৪০০০ মিলিয়ন ডলার। দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন জেলার সরাসরি যোগাযোগ শ্রমের গতিশীলতা বাড়াবে। সেতুর সুফল হিসেবে দুই কোটির অধিক বেকারের কর্মসংস্থান ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেতুর উভয় পাশেই ব্যাপক হারে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ ঘটবে, যা সচল রাখবে দেশের অর্থনীতির চাকা।
পদ্মা সেতু ঘিরে পদ্মার দুই পারে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করছে সরকার। আধুনিক নগর গড়ে তোলার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মহলের সঙ্গে এরই মধ্যে পরামর্শ শুরু করেছে সরকার। পদ্মা সেতু ঘিরে পর্যটনে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। অনেক আধুনিক মানের হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠবে এখানে। এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এ সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সে ক্ষেত্রেও এ সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উত্তরের বিভাগ রাজশাহী ও রংপুরের চেয়ে পিছিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের খুলনা ও বরিশাল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী, ওই বছর দেশে মোট অর্থনৈতিক স্থাপনা ছিল ৭৮ লাখের কিছু বেশি। এর মধ্যে তখনকার সাতটি বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে কম স্থাপনা ছিল সিলেট, বরিশাল ও খুলনায়। যেমন, রংপুরে অর্থনৈতিক স্থাপনার সংখ্যা ছিল ১০ লাখের বেশি। বরিশালে তা ছিল সাড়ে ৩ লাখের মতো। অবশ্য পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা খুলনা-যশোর অঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়নের সম্ভাবনা দেখছেন। এর সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি রয়েল বেঙ্গল টাইগার সমৃদ্ধ সুন্দরবন ও সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের অভাবনীয় সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে বিশাল পর্যটনশিল্প।
শিল্পায়ন ও পর্যটনকে কেন্দ্র করে দক্ষিণবঙ্গজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে আধুনিক নগরায়ণ। পদ্মাপারে গড়ে উঠবে বিশ্বমানের প্রজাপতি জাদুঘর, সিঙ্গাপুরের আদলে অলিম্পিক ভিলেজ। সেতুর পাশেই ক্রীড়া পল্লী ও অলিম্পিক কমপ্লেক্স নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মার চরে সব রকম সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ক্রীড়া পল্লী নির্মাণসহ সুবিশাল অলিম্পিক কমপ্লেক্স গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে ক্রীড়া প্রশিক্ষণ আরও এগিয়ে যাবে। স্থানীয়রা পদ্মাপারে আধুনিক শহর গড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। এছাড়া সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কারণে বাস্তুচ্যুত ক্ষতিগ্রস্তরা পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোয় আধুনিক শহরের সুবিধা ভোগ করছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণকে আশপাশের এলাকাবাসীর জন্য আশীর্বাদ বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের মধ্যে খুলনা বিভাগ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট আমানতের ৬ শতাংশ। ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের সাড়ে ৩ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে মোট আমানতের পরিমাণ সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট আমানতের সাড়ে ৪ শতাংশ। মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩ শতাংশ। পদ্মা সেতু চালু হলে ওপারে বিনিয়োগ বাড়লে ঋণের চাহিদা বাড়বে; তখন ঋণের প্রবাহও বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানসহ অর্থনৈতিক সূচকগুলো বেশি সচল হবে এবং নতুন নতুন খাত যুক্ত হলে মানুষের আয় বাড়বে। তখন সঞ্চয়ও বাড়বে, যা জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়ক হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, পদ্মা সেতু চালু হলে ২০২২ সালে প্রতিদিন গড়ে যানবাহন চলাচল করবে প্রায় ৩৫ হাজার। এ থেকে রাজস্ব আয় হবে ৮২২ কোটি টাকা। ২০২৫ সালে তা বেড়ে ৩৯ হাজারে দাঁড়াবে। রাজস্ব আয় হবে প্রায় হাজার কোটি টাকা। ২০৩০ সালে তা আরও বেড়ে ৫৮ হাজার যানবাহন চলবে। রাজস্ব আয় হবে ১ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। ২০৩৫ সালে তা আরও বেড়ে ৬৬ হাজার যানবাহন এবং রাজস্ব আয় হবে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। এভাবে ২০৫০ সালে যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে ৭৬ হাজার। রাজস্ব আয় বাড়বে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং তাদের এক সমীক্ষায় বলছে, সেতুটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়াবে। এ সমীক্ষায় রেল সংযোগের বিষয়টি ছিল না। পরে রেল সংযুক্ত হওয়ায় সেতুটি আরও বাড়তি সুবিধা নিয়ে আসবে বলার অপেক্ষা রাখে না।
পদ্মা সেতু চালু হলে উত্তরের মতো ফসলের বাড়তি দাম পাওয়া যাবে বলে মনে করেন দক্ষিণের কৃষকরা। তাদের এ আশার দিকটি উঠে এসেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক সমীক্ষায়। সমীক্ষা বলছে, এতে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৭৫০ জনের সাক্ষাৎকার নেয় আইএমইডি; যাদের ৯৫ শতাংশ বলেছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষিপণ্যের পরিবহন সহজ হবে।
এদিকে, এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়, সেতুটি দেশের জিডিপির হার বাড়াবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়াবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। দারিদ্র্য বিমোচনের হার বাড়াবে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ। সেতু চালু হলে কৃষকরা প্রতিদিন সহজে শস্য, সবজি ও মাছ ঢাকায় পাঠাতে পারবেন। উদ্যোক্তারা অপেক্ষায় পুঁজি নিয়ে- কাঁচামাল ও পণ্য আনা-নেয়া সহজ হলে তারা কারখানা করবেন। তরুণদের জন্য নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হবে। পরিবহন ব্যবসায়ীরা আরও বেশি বাস-ট্রাক নামাতে পারবেন।
সার্বিকভাবে বলা যায়, এ সেতু শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করবে না, অর্থনৈতিক সুফল পাবে ২১ জেলার মানুষ। জিডিপি বাড়বে ১.২৩ শতাংশ। নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে কাজে না লাগানোর ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তেমন গড়ে ওঠেনি ভারী শিল্প-কারখানাও। তবে পদ্মা সেতু চালু হলে এ চিত্র অনেকটাই বদলে যাবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।
আনন্দবাজার/শহক