দেশের ক্রমসম্প্রসারণশীল জাতীয় অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও ভ্রাম্যমাণ উদ্যোক্তাদের অবদান কম নয়। প্রান্তিক পর্যায়ের অর্থনীতি চাঙা করতে তারা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। দারিদ্র্য সীমা অতিক্রম করে তারা নিম্ন মধ্যবিত্তের কাতারে উঠে আসায় অর্থনীতির পাশাপাশি ইতিবাচকভাবে সমাজিক পরিবর্তনও ঘটছে। পাল্টে যেতে শুরু করেছে প্রান্তিক মানুষের জীবন ও জীবিকার লড়াই।
তবে প্রান্তিক অর্থনীতির বদলে যাওয়ার মধ্যে হঠাৎ করেই ধেয়ে আসা করোনা মহামারির প্রবল তোড়ে দিকবিদিকশূন্য হয়ে পড়তে হয়েছিল তাদের। বিশেষ করে শহরকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র ও ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী ও দিনভিত্তিক উদ্যোক্তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। অনেকেই পুঁজি হারিয়ে ফিরেছিলেন গ্রামে। কেউ কেউ আবার জীবিকাই বদলে ফেলেছিলেন। তবে করোনার সেই ভয়াবহতা কমে আসায় বর্তমানে তারা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন।
ইতোমধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের নানা প্রতিষ্ঠানসহ ব্যবসা ও অর্থনীতি খাতের দরজা খুলে দেয়ার পর অর্থনীতির চাকা আবার ঘুরতে শুরু করেছে। যারা কাজ হারিয়েছিলেন তারা কাজ খুঁজে নিচ্ছেন। শহর ছেড়ে যারা গ্রামে চলে গিয়েছিলেন তারাও ফিরছেন। প্রাণচাঞ্চল্য ফিরছে রাজধানীসহ দেশের শহরগুলোতে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আবারো কর্মমুখর হয়ে পড়েছেন। করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রাণপণ লড়াই করছেন তারা। যারা করোনাকালের সরকারি প্রণোদনার দিকে না তাকিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই নিজেরাই করেছেন। বর্তমানে তারা জীবিকার টানে নেমে পড়েছেন ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র ব্যবসা ও উদ্যোগ সচল করার। রাজধানীসহ দেশের শহরাঞ্চলে এমন চিত্রই দেখা যাচ্ছে।
সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গতকাল শুক্রবার সকালে সরেজমিন গিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার সঙ্গে। করোনার কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ফজলুল হকের খাতা-কলম বেচাবিক্রি বন্ধ ছিলো। তিনি আনন্দবাজারকে বলেন, বেচা-বিক্রি না থাকায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আবির প্রোডাক্ট নামে খাতা-কলমের কারখানাটিও। চার মাসের বেশি সময় বাড়িতে গিয়ে কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর আবারো ঢাকায় ফিরে এসেছি। এখন ফেরি করে খাতা-কলমসহ স্টেশনারী সামগ্রী বিক্রি করছি। ফজলুল হক খানিকটা হতাশার সুরে বলেন, করোনার আগে দৈনিক ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা বিক্রি হলেও এখন মাত্র দুই থেকে তিন হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। তবে সামনের দিকে বেচা-বিক্রি বাড়বে বলে আশা করছেন।
একইরকম পরিস্থিতি রাজধানীর মানিকনগর বাজারে মাছ কাটাকে জীবিকা হিসেবে নেয়া নজরুল ইসলাম। মাছকেটে তার যা আয় হয় তা দিয়ে তার সংসার চলে। তবে করোনায় লকডাউনে বন্ধ ছিলো তার কাজ। এসময় বাসা বাড়াসহ যাবতীয় খরচ চালাতে গিয়ে আগের জমানো সব অর্থ খরচ হয়ে যায়। সংসার চালাতে সমিতি থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নেন। করোনার পর বাজারে তার বেড়ে যাওয়ায় ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।
মতিঝিল শাপলা চত্বরে ভ্যানগাড়িতে ফেরি করে চা-বিস্কুট বিক্রি করেন মুসলিম। তিনি বলেন, করোনার পর মানুষের পকেটে আগের মতো টাকা নেই। যার কারণে বিক্রিও কমে গেছে। সব মিলিয়ে দিনে ৪ থেকে ৫‘শ টাকা আয় হয়। তবে আগামীতে এই আয় আরও বাড়তে পারে বলে মুসলিম আশা করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সংলগ্ন এলাকাতে ফুটপাতে দা-বটিসহ বিভিন্ন লোহার তৈরি সামগ্রী বিক্রি করেন আব্দুল কাদের। দীর্ঘ চার দশক ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কাদের জানান, লোহার দাম বেড়ে যাওয়ায় দা-বটিসহ বিভিন্ন সামগ্রীর দাম বেশি। লকডাউনের পর দোকান খুললেও দিনে তিন থেকে চার হাজার টাকার বেশি বিক্রি হয় না। যেখানে আগে আট থেকে ১০ হাজার টাকা বিক্রি হতো। তবে আগামীতে বিক্রি বাড়ার আশা করছেন তিনি।
গোপীবাগ রাস্তার মোড়ে ফুটপাতে বসে জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন শ্যামলাল। তিনি জানান, করোনায় লকডাউনে অধিকাংশ সময় তার দোকান বন্ধ ছিলো। কাজ না থাকায় কোনো উপার্জন ছিলো না। এখন দিনে আড়ইশ থেকে তিনশ টাকা আয় হচ্ছে। তবে করোনার আগে দিনে আয় ৫ থেকে ৬’শ টাকা ছিলো। আগের মতো সবকিছু স্বভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা করছেন তিনি।
বই বিক্রেতা ফজলুল হক, মাছকাটা নজরুল, ফেরিওয়ালা মুসলিম, কামার কাদের আর মুচি শ্যামলালের মতো কয়েক লাখ মানুষ নানাভাবে জীবিকা নির্বাহ করছেন রাজধানীতে। তাদের নেই সুনির্দিষ্ট ঠিকানা। নেই আয়ের নিশ্চিত পথ। তারপরেও তারা জীবন জীবিকার জন্য লড়াই করছেন। নিজেদের ভাগ্য বদলের পাশাপাশি পরিবারের ব্যয় বহন করছেন। বেকার না থেকে আয় করছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি উদ্যোক্তায় পরিণত হচ্ছে। প্রান্তিক এই মানুষদের হাত ধরেই বদলে যাচ্ছেন স্থানীয় পর্যায়ের অর্থনীতি।
সূত্রমতে, করোনা মহামারি মোকাবিলা ও ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার যে ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তাতে মোট বরাদ্দ ছিল এক লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। গেল জুলাইয়ে তিন হাজার ২০০ কোটি টাকার আরও পাঁচটি প্যাকেজ ঘোষণা করে। সব মিলিয়ে ২৮টি প্যাকেজে বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়ায়ে এক লাখ ৩১ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ছিলেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারাও। তবে একেবারেই প্রান্তিক পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ কিংবা শ্রমজীবী উদ্যোক্তারা এসব সুবিধায় তেমনভাবে উপকৃত হয়নি। অবশ্য, করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে চাঙা করতে সরকার অতিক্ষুদ্র, কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য যে ২০ হাজার কোটি টাকার স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধাসহ একাধিক প্রণোদনা প্যাকেজ গ্রহণ করেছে, তার বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয়েছে।
আনন্দবাজার/শহক