শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের কোম্পানি আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের শেয়ার দর বৃদ্ধিতে হঠাৎ করেই ছন্দ পতন হয়েছে। লাফিয়ে ওঠা কোম্পানির শেয়ার দর গত দেড় মাসে প্রায় ৯৭ টাকা কমেছে। কারণ হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বেচাকে দোষারোপ করা হচ্ছে।
এ নিয়ে কোম্পানির শেয়ার ধারন করা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মাঝে এক ধরনের দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য কোম্পানিটির শেয়ার দর পতনসহ প্রাতিষ্ঠানিকরা শেয়ার ধারন কমার প্রকৃত কারণ জানে না আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের কর্তৃপক্ষ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ছয় মাসে শেয়ার প্রতি ২৬৬ টাকা বাড়লেও শেষ দেড় মাস শেয়ার দর কমেছে ৯৭ টাকা। গত সোমবার দর দাঁড়ায় ৩৭০ টাকায়। কিন্তু গত ২ অক্টোবর হিসেবে শেয়ার প্রতি দর করেছে ৯৭ টাকা। পতনের এ অক্টোবরে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির দাপট বেড়েছে। ফলে কোম্পানিটির শেয়ার দর বৃদ্ধির হঠাৎ করেই ছন্দ পতন দেখা যায়।
গত সোমবার কোম্পানির শেয়ার প্রতি দর দাঁড়িয়েছে ৩৭০ টাকা। যা গত ১৭ মে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি দর ছিল ১০৬ টাকা। এ সময়ের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি দর বেড়েছে ২৬৪ টাকা বা ৩৪৯ শতাংশ। বর্তমানে কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা এক কোটি ৫২ লাখ ৪৬ হাজার। সেই হিসাবে গত সোমবার কোম্পানিটির মোট শেয়ারের বাজারমূল্যে দাঁড়িয়েছে ৫৬৪ কোটি ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা। গত ১৭ মে মোট শেয়ারের বাজারমূল্যে ছিল ১৬১ কোটি ৬০ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। এই সময়ের ব্যবধানে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের বাজারমূল্যে বেড়েছে ৪০২ কোটি ৪৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।
উচ্চমূল্যে বিক্রয়ের লক্ষে এক চক্র কোম্পানিটির শেয়ার দর বাড়িয়েছে এমন চিত্র ফুঠে ওঠে। গত ছয়মাসে শেয়ার প্রতি দর বেড়েছে ২৬৪ টাকা। অবশ্য ২ অক্টোবরে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি দর ছিল ৪৬৭ টাকা। যা ১৭ মে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি দর ছিল ১০৬ টাকা। কোম্পানিটি বিনা কারণে বেড়ে হঠাৎ কমা চোখে পড়ার মতো। তাই নিরাপদ বিনিয়োগ স্বার্থে শেয়ারটির দর বাড়ার কারন জানতে সংশ্লিষ্ট রেগুলেটরদের দৃষ্টি আকর্ষন করেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।
শেয়ার দর বৃদ্ধি প্রসঙ্গে কোম্পানির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, শেয়ার বৃদ্ধির কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আমাদের কাছে নেই। কোম্পানির শেয়ার দর গত ছয় মাস ধরে কেন বাড়ছে, সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
বেশি দরে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় প্রসঙ্গে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ও রশিদ ইনভেস্টমেন্ট সার্ভিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ রশিদ লালী বলেন, বিনিয়োগকারীকে অতি উচ্চ দর দিয়ে শেয়ার কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ অতি উচ্চ দরে শেয়ার কেনা হলে বিনিয়োগ বড় ঝুঁকিতে থাকে।
অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর হিসেবে আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের মোট শেয়ারের মধ্যে ২০ দশমিক ৬৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ধারন করেছিল। কিন্তু ৩১ অক্টোবর তাদের শেয়ার ধারন দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। এই সময়ে প্রাতিষ্ঠানিকরা অতি উচ্চমূল্যে কোম্পানিটির শেয়ার এক দশমিক শূন্য নয় শতাংশ বা এক লাখ ৬৬ হাজার ১৮১টি বিক্রয় করেছে। অবশ্য এই সময় প্রাতিষ্ঠানিকদের শেয়ার ধারন কমলেও পরিবর্তন হয়নি কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার ধারনে।
অপরদিকে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মধ্যে ৪৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ ধারন করে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ৩১ অক্টোবর শেয়ার ধারন দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিকশূন্য ৮ শতাংশ। এই সময়ে প্রাতিষ্ঠানিকদের বিক্রির এক দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ বা ১ লাখ ৬৬ হাজার ১৮১টি শেয়ার অতি উচ্চমূল্যে কিনেছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
প্রাতিষ্ঠানক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রয় প্রসঙ্গে কোম্পানিটির ওই কর্তকর্তা বলেন, কোম্পানির শেয়ার কারা ধারন করবে, সেটা আমরা নিয়ন্ত্রন করিনা। তবে শেয়ার বিক্রয় কারণে প্রাতিষ্ঠানিকদের শেয়ার ধারন আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। এর কারণে কোম্পানিটির শেয়ার দর কমছে কিনা, সেটা আমি বলতে পাচ্ছি না।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধারন কমা প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেছেন, প্রাতিষ্ঠানিকরা বুঝে শুনে বিশ্লেষণেরে মাধ্যমে পুঁজিবাজারে শেয়ার ক্রয় বিক্রয় করে। তারা এলোমেলো শেয়ার কিনেন না। তাই কোনো কোম্পানিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ কমে যাওয়া ভালো খবর নয়।
কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের সবশেষ আর্থিক হিসাব অর্থবছরে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২১-২০২২) শেয়ার প্রতি সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৪৪ টাকা। গত সোমবার হিসেবে শেয়ার প্রতি সম্পদ সাড়ে ২০ গুণ বেশি দরে কেনাবেচা হয়েছে। মানে শেয়ার প্রতি সম্পদের ১৮ দশমিক ৪৪ টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে ৩৭০ টাকা দরে। এই ধরনের অতিমূল্যে শেয়ারটির বেচাকেনা বাঁকা চোখে দেখছেন অনেকে।
আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের আর্থিক হিসাব অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২১-২০২২) শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ১৩ টাকা। যা আগের বছরের একই সময় হয়েছিল দশমিক ৮৯ টাকা। এ হিসেবে ইপিএস বেড়েছে চার দশমিক ২৪ টাকা। এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে রয়েছে শেয়ার ব্যবসা থেকে বড় মুনাফা। কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে শেয়ার ব্যবসায় সিকিউরিটিজ বিক্রি থেকে মুনাফা হয়েছে ৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ও আনরিয়েলাইজড মুনাফা হয়েছে ১৪ লাখ টাকা। যার আগের বছরের একই সময়ে ছিল শূন্য। শেষ প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটির নগদ প্রবাহ দশমিক ৭৭ টাকা।
সর্বশেষ আর্থিক হিসেব অর্থবছর (২০২২-২০২১) জন্য কোম্পানিটি ২০ শতাংশ ক্যাশ ও ১০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড প্রদানের ঘোষনা দিয়েছে। কোম্পানিটির ডিভিডেন্ড বন্টনের জন্য রেকর্ড ডেট নির্ধারন করেছে চলতি বছরের ১৮ নভেম্বর। এজিএম আগামি বছরের ১২ জানুয়ারি বেলা সাড়ে ১১টায় ডিজিটাল প্লাটফর্মে অনুষ্ঠিত হবে।
গেল ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের ব্যবসা হচ্ছে গ্যালভানাইজড কারাজেটেড শিট, লোহার পাইপ ফিটিংস ও ব্রেক ড্রামস তৈরি ও বাজারজাত। কোম্পানিটি ১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৩৫ দশমিক ৩২ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালক ধারন করেছে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ১৯ দশমিক ৬০ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারী ৪৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ শেয়ার ধারন করেছে।
আনন্দবাজার/শহক