শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাতের মুঠোয় দিনবদল

  • বদলে যাচ্ছে প্রচলিত ব্যবসার চরিত্র
  • গৃহিনী থেকে প্রান্তিক বেকার সবাই উদ্যোক্তা
  • বাজার ১৬ হাজার কোটি টাকার
  • কারোনার মধ্যেই পাঁচ লাখ উদ্যোক্তা তৈরি
  • আগামী এক বছরে যুক্ত হবে আরো দুই লাখ

ই-কমার্স

ইলেকট্রনিক কমার্স বা ই-কমার্স বা ই-বাণিজ্য একটি বাণিজ্য ক্ষেত্র, যেখানে কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেম অর্থাৎ ইন্টারনেট বা অন্য কোনো কম্পিউটার নেটওইয়ার্কের মাধ্যমে পণ্য বা সেবা কেনা বেচা হয়ে থাকে। আধুনিক ইলেকট্রনিক কমার্স সাধারণত ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের মাধ্যমে বাণিজ্যিক কাজ পরিচালনা করে থাকে।

ইন্টারনেট প্রযুক্তি আর স্মার্টফোন উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান পণ্য কিংবা অদৃশ্য সেবা বিক্রির ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে প্রচলিত বাণিজ্যের ধারণা আমূল বদলে গেছে। বিপণন ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে ঘটে গেছে মহাবিপ্লব। অনলাইন বা ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্য কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ডিজিটাল কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে ইলেকট্রনিক কমার্স বা ই-কমার্স অথবা ই-বাণিজ্যের মাধ্যমে। গেল প্রায় এক দশক ধরে ই-কমার্স সাইটগুলো দেশের ব্যবসা অঙ্গনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কম বিনিয়োগে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এই ব্যবসা শুরু করা যায়। গৃহিণী থেকে শুরু করে লাখো বেকার নিজ নিজ ট্যাগলাইন থেকে বেরিয়ে এসে হয়ে উঠতে পারেন একজন সফল ই-কমার্স ব্যবসায়ী।

মূলত, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার, সমন্বিত সরবরাহ নিগড় ব্যবস্থাপনা, ইন্টারনেট বিপণন, ইলেকট্রনিক ইনভেনটরি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, অনলাইন লেনদেন প্রক্রিয়াকরণ এবং স্বয়ংক্রিয় তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতিসহ বিচিত্র ধরনের প্রযুক্তির মাধ্যমে এর ব্যবসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ক্রেতা বা সেবা গ্রহীতাদের জন্য ই-কমার্স প্লাটফর্মগুলো ওয়েব পোর্টাল তৈরি করে এবং ই-মেইলের মতো সাধারণ প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করে অনলাইন মার্কেটপ্লেস থেকে অনলাইন কেনাকাটা সহজতর করে তোলে। অর্থনীতিবীদদের মতে, গ্রাহকদের জন্য বিভিন্ন পণ্য সহজে খুঁজে পেতে ও তুলনামূলক বিশ্লেষণের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়ায় ই-কমার্স প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। ইতোমধ্যে এই মার্কেটে দেশীয় জায়ান্ট কোম্পানিগুলির পাশাপাশি নাম লিখিয়েছে আন্তর্জাতিক জায়ান্টরাও।

বাংলাদেশে ই-কমার্স শুরু হয়েছিল ৯০ এর দশকের শেষদিকে। প্রথম ই-কমার্স ভিত্তিক কোম্পানি শুরু হয় বাগডুমডটকম এর মাধ্যমে। কিন্তু, ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশের স্থানীয় ই-বাণিজ্য শিল্প বিকশিত হতে শুরু করে। ২০১৩ সালে প্রথম, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে আইসিটি বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিলের সমর্থিত দেশে প্রথমবারের মতো “ই-বাণিজ্য সপ্তাহ” পালন করেছে। সেই থেকেই নতুন সম্ভাবনা দেখতে শুরু করে দেশ।

আরও পড়ুনঃ  ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই : প্রধানমন্ত্রী

সূত্রমতে, বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজারের আকার বর্তমানে প্রায় ১৬ হাজার হাজার কোটি টাকার। করোনা মহামারির সময় অর্থনীতির সব খাত যখন নাজুক তখনও দেশের ই-কমার্স খাতে তৈরি হয়েছে অন্তত পাঁচ লাখ নতুন উদ্যোক্তা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী এক বছরের মধ্যে এখাতে যুক্ত হবেন আরো প্রায় দুই লাখ উদ্যোক্তা। দেশে গেল প্রায় এক দশকে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও হঠাৎ করেই নানা সমালোচনা আর বিতর্কের মুখে পড়তে হয় এ খাতটিকে। ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠা কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতসহ গ্রাহক ও মার্চেন্টদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ উঠে। ফলে এ খাতে গড়ে উঠা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ প্রতিষ্ঠান কোনো ঘোষণা ছাড়াই ব্যবসা বন্ধ করে দেয়।

কিছুদিন আগে আলোচিত ই-ভ্যালির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী, ই-অরেঞ্জের মালিক ও তার স্বামী এবং কিউকমের সিইও রিপন মিয়া ও প্রতিষ্ঠানটির হেড অব সেলস অফিসার আরজে নিরবকে গ্রেফতারের পর এ খাতের বিরূপ চিত্র দৃশ্যমাণ হয়। যা গোটা খাতকেই ফেলে দিয়েছে আস্থার সংকটে। এমন পরিস্থিতিতে এ খাতের ব্যবসায়ীদের আগামী দুই মাসের মধ্যে নিবন্ধিত হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা রাখার (ডিপোজিট) বাধ্যবাধকতা জারি করা হয়।

এ ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বেশ কিছুদিন আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরুর আগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নিরাপত্তা আমানত রাখতে হবে। সব গোয়েন্দা সংস্থা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমের ওপর নজর রাখবে। তবে এ ঘোষণার পর গ্রাহকরা তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলছেন, এর আগে ই-কমার্স খাতে আস্থার জায়গা ধরে রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিজিটাল কমার্স পরিচালনায় যে নীতিমালা ও নির্দেশিকা জারি করেছে তা এখনও কাগজে কলমেই রয়ে গেছে। শুধু নীতিমালা কিংবা আদেশ জারির মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তবতার আলোকেই নজরদারি বাড়ানোর দাবি তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।

সরকারি নির্দেশনায় প্রধানত পণ্য সরবরাহ ও রিফান্ড দেওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিলো। সেখানে বলা ছিল, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও ক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে পাঁচদিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। ভিন্ন শহরে অবস্থান করলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য স্টকে না থাকলে সেটার কোনো পেমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না। আগাম পরিশোধ করা টাকা পণ্য সরবরাহের পরই বিক্রেতার অ্যাকাউন্টে জমা হবে। ক্রেতার অগ্রিম মূল্য পরিশোধের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্যটি ডেলিভারি-ম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করে তা টেলিফোন, ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে জানাবে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো।

আরও পড়ুনঃ  মজনুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি-ম্যান পণ্যটি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেবে। সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য বা সেবা ডেলিভারি-ম্যানের কাছে হস্তান্তর করার মতো অবস্থায় না থাকলে পণ্য মূল্যের ১০ শতাংশের বেশি অর্থ অগ্রিম নিতে পারবে না। আর নীতিমালা ভঙ্গ করলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। যেমন কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল করা। তবে নীতিমালা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

ই-কমার্স খাতে সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেছেন, খাতটি যেভাবে বাড়ছে মনিটরিং সেই হারে বাড়ছে না। এই ব্যবসা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে হচ্ছে। ফলে নিয়ন্ত্রণ, পর্যবেক্ষণও সহজ হবে। প্রত্যেকটি লেনদেন, অর্ডার মনিটরিং করতে হবে। কোথাও কোনো ব্যত্যয় হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। আগামীতে এ খাতে আরও প্রবৃদ্ধি হবে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিতে হবে। নতুবা ই-কমার্স খাত এগোতে পারবে না। সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে ঠিকই কিন্তু সেটা হয়েছে অনেক দেরিতে। তারপরও নিবন্ধনের সব শর্ত যদি বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে ই-কমার্স এবং গ্রাহক সবাই উপকৃত হবেন।

ই-কমার্সে ভোক্তা ও মার্চেন্টদের আস্থা ফেরানোর পাশাপাশি ই-ক্যাবের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর সমিতি ই-ক্যাবের জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গির আলম বলেন, শুরু থেকেই সংগঠনের সদস্যদের ই-কমার্স খাতের নীতিমালাটি মেনে ব্যবসা পরিচালনার আহ্বান জানিয়ে এসেছি। আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ এসেছে, সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করেছি। প্রতারণায় অভিযুক্ত ১৬ প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শাতে বলেছিলাম। প্রাথমিক তদন্তে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, চারটি প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  চীনের ল্যাবরেটরিতেই করোনাভাইরাসের উৎপত্তি : ট্রাম্প

এদিকে, ক্রেতাদের পাশাপাশি কয়েকটি ব্যাংক ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানও আস্থা রাখতে পারছে না কোনো কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওপর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, নিরাপদ পরিশোধ ব্যবস্থার জন্য শিগগিরই একটি ‘এসক্রো সার্ভিস’ করা হবে। এটা একটা মধ্যস্বস্তভোগী সংস্থার মতো। এসক্রো সার্ভিস চালু হলে ক্রেতারা আগাম টাকা পরিশোধ করলেও পণ্য সরবরাহ না হওয়া পর্যন্ত বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে তাদের টাকা জমা হবে না। এছাড়া সময়মতো পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হলে সাতদিনের মধ্যে মূল্য ফেরত দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে।

ই-কমার্স কোম্পানির পেইড আপ ক্যাপিটাল রাখতে হবে জানিয়ে ব্যরিস্টার মাহবুব শফিক বলেন, আইন ও নীতিমালা না থাকা এবং মনিটরিং না করার সুযোগ নিয়েছে প্রতারকেরা। ই-কমার্স কোম্পানি করতে পেইড আপ ক্যাপিটাল থাকতে হয়। আর তার বিপরীতে কত দায় নিতে পারবে তাও হিসাব করে দেয়া হয়। ভারতেও এটা আছে। আশার কথা হচ্ছে আমাদের দেশেও এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ। নতুন এ নির্দেশনায় ক্ষতিপুরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যা অত্যন্ত স্বস্তির। নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে এ খাতে আস্থা ফিরবে বলে আশা করা যায়।

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-কমার্স সেক্টরের প্রবৃদ্ধি যাতে এই নিয়মগুলির দ্বারা বাধাগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ই-কমার্স সেক্টরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। ই-ক্যাব লকডাউন চলাকালীন ই-কমার্স সেক্টরে এক লাখ নতুন চাকরি তৈরির আশা করেছে। যা আগামী ৩-৪ বছরের মধ্যে চার থেকে পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ও মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স সেল-১ এর প্রধান তৌফিকুর রহমান আনন্দবাজারকে বলেন, কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতসহ গ্রাহক ও মার্চেন্টদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ উঠায় এ খাতে আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে। আমরা আস্থা ফিরিয়ে আনতে যা যা করণীয় সবকিছু করছি।

এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান এএইচএম শফিকুজ্জামান আনন্দবাজারকে বলেন, এ খাতের ব্যবসায়ীদের নিবন্ধিত হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা রাখার (ডিপোজিট) বাধ্যবাধকতা জারি করা হয়। নিবন্ধনের জন্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে কী কী নিয়ম মেনে চলতে হবে সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ খাতে আস্থা ফেরাতে যা যা করণীয় সবকিছুই করা হবে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন