চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে বাংলাদেশ
রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ৪৩ হাজার কোটি টাকার
কর্মসংস্থান ১৫ লাখ
বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিস্ময়কর সাফল্যের পথ ধরে বিশ্বজুড়ে শুরু হওয়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জোয়ারে ভাসছে বিশ্বের প্রযুক্তিপণ্যখাত। এক দশকের কিছু আগে শুরু হওয়া ডিজিটাল বিপ্লবের হাত ধরে বাংলাদেশও ভাসছে সে জোয়ারে। প্রযুক্তিখাতের নতুন নতুন ব্যবসা উদ্যোগ বা স্টার্টআপের অপার সম্ভাবনা ঝুলে রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। সফলতার মুখ দেখছে বহু উদ্যোগ। আবার প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের ঘাটতির কারণে মুখ থুবড়েও পড়ছে অনেকগুলো। তবে অপার সম্ভাবনার সুযোগ নিতে দেশ-বিদেশের বহু বিনিয়োগকারী এ খাতে বিপুল অর্থ লগ্নি করার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে স্টার্টআপের ইতিহাস একেবারেই আনকোড়া বলা যায়। এক দশক খুব বেশি সময় নয় নতুন এ ব্যবসা উদ্যোগের জন্য। বাংলাদেশে মূলত বিকাশকেই প্রথম সফল স্টার্টআপ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। যা শুরু হয়েছিল গেল ২০১০ সালে। অবশ্য এর আগে সেল বাজারের যাত্রা শুরু হয়েছিল অনেকটা নীরবেই। পরে তা গ্রামীণফোনের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংকের বাণিজ্যিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) বিকাশে বিনিয়োগ করে। এর পরের বছর ২০১৪ সালে একই স্টার্টআপে বিনিয়োগ করে বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
বছর চারেক পর ২০১৮ সালে এসে একই খাতে বিনিয়োগ করে বিশ্বখ্যাত ই-কমার্স আলীবাবার সহযোগী প্রতিষ্ঠান এন্ট ফাইন্যান্সিয়াল। এতে বিকাশের মূল্যমাণ দাঁড়ায় প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বা প্রায় আট হাজার কোটি টাকায়। যা যেকোনো স্টার্টআপের জাগতে বড় এক মাইলফলক বা উইনিকর্ন। আর বাংলাদেশের স্টার্টআপ জাগতে বিকাশই প্রথম উইনিকর্ন। তবে গেল কয়েক বছরে দেশের স্টার্টআপ জগতে বলা যায় বিপ্লব ঘটে গেছে। প্রযুক্তিখাতের এই উদ্যোগের আওতায় চলে এসেছে বহুমুখী সেবা। এর সুবাদে এখন মোবাইল অ্যাপেই মিলছে বিমান-বাস- ট্রেনের টিকেট। হাজির হচ্ছে রাইড শেয়ারিং। ঘর গৃহস্থালির বিভিন্ন সার্ভিস এমনকি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনও পাওয়া যাচ্ছে অ্যাপের মাধ্যমে। সহজে বা হাতের কাছে সেবা পাওয়ায় বাড়ছে ব্যবহৃারকারীর সংখ্যা। দ্রুত বাজার সম্প্রসারণ ঘটছে। এতে স্টার্টআপে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছেন অনেকে।
সংশ্লিষ্টখাতের উদ্যোক্তারা বলেছেন, পর্যাপ্ত নীতি সহায়তা দেয়া হলে স্টার্টআপের আওতায় দেশে আরো বহু নতুন ব্যবসা গড়ে উঠবে। সৃষ্টি হবে বিপুল কর্মসংসংস্থান। একই অভিমত জানিয়ে প্রযুক্তিখাতের বিশেষজ্ঞরা স্টার্টআপ খাতের সম্ভাবনাকে কাজে সরকারকে নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে কর অব্যাহতি, অনুদান, সহজ শর্তে ঋণ এবং ইক্যুইটি বিনিয়োগের সুবিধা। তথ্য ও প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, স্টার্টআপের আওতায় নতুন সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার প্রসার হবে। আগামী ২০২৫ সালে ৪৩ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা নির্ভর সফটওয়্যার রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। স্টার্টআপের মাধ্যমে নতুন ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানও সম্ভব হবে।
এসবিকে ফাউন্ডেশন ও এসবিকে টেক ভেঞ্চারের চেয়ারম্যান সোনিয়া বশির কবির আনন্দবাজারকে বলেন, স্টার্টআপ হচ্ছে ব্যবসা কেন্দ্রিক নতুন কিছু খুঁজে বের করা। প্রযুক্তি আর বিজ্ঞাননির্ভর জীবনে স্টার্টআপে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে চলমান জীবনের বিভিন্ন সেবা বিক্রি করা হয়। বর্তমানে মোবাইলের ব্যাংকিং লেনদেনও স্টার্টআপের একটি আবিষ্কার। এর বাজার প্রতিদিনই বাড়ছে।
সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম আনন্দবাজারকে বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে স্টার্টআপে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের দেশে এখাতে ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে স্টার্টআপে উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আমাদের দেশের তরুণরা এরই মধ্যে স্টার্টআপে আগ্রহী হয়ে উঠলেও বিরাজমান সমস্যার কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে। পরামর্শ দিয়ে আজিজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের স্টার্টআপদের উদ্ভাবনী ধারণাকে ব্যবসায় রূপান্তরিত করে দেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ উৎসাহিত করা সম্ভব। এতে বেকারত্ব দূর হবে।
উল্লেখ্য, গেল তিন অর্থবছরের বাজেটে প্রযুক্তিনির্ভর নতুন আবিষ্কারে বাজেট বরাদ্দ রাখা হলেও প্রকৃত উদ্যোক্তাদের অভাবে বরাদ্দ অর্থের পুরোপুরি ছাড় করা সম্ভব হয়নি। আগের ধারাবাহিকতায় ঘোষিত বাজেটেও প্রযুক্তি উদ্যোক্তা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে সরকারি উদ্যোগে স্টার্টআপের আওতায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতভিত্তিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বাড়াতে দক্ষ জনবল তৈরির উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এমপি সম্প্রতি বলেছেন, স্টার্টআপে বাংলাদেশে সম্ভাবনা রয়েছে। ঘোষিত বাজেটে এখাতের প্রধানতম সাফলতা বিকাশে একশ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই অর্থ বিতরণে নীতিমালা করছে সরকার। এর আওতায় যোগ্য উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে কাজও করছে সরকারের আইসিটি বিভাগ। ইতোমধ্যে অর্ধশতকের বেশি কোম্পানিকে আর্থিক সুবিধা দেয়া হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে এ খাত থেকে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে আরো জানান, স্টার্টআপ উদ্যোগের মাধ্যমে দেশে ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে দুই হাজার পাঁচশর বেশি স্টার্টআপ ব্যবসা চলছে। ৪০টির বেশি এক্সেলেরেটর এবং ইনকিউবেটর প্রোগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে। এরই মধ্যে এখাতে বিদেশি বিনিয়োগও এসেছে। যা দেশের জন্য গর্বের। মূলত, প্রযুক্তিনির্ভর স্টার্টআপ ব্যবসায়ে অংশগ্রহণকারী ও অ্যাপ ব্যবহারকারীদের বেশির ভাগই তরুণ। তবে দেশে সরকারি উদ্যোগে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ সীমিত থাকায় অনেকে ব্যক্তিগতভাবে ইন্টারনেট কিনে ব্যবহারে আগ্রহী হয় না।
স্টার্টআপের বৈশ্বিক দিক তুলে ধরে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ই-জেনারেশন গ্রুপের চেয়ারম্যান শামীম আহসান আনন্দবাজারকে বলেন, চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় স্টার্টআপের মাধ্যমে জোরসোরে নতুন ব্যবসা করতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে কাজ চলছে। আমাদের দেশ এক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে। তবে স্টার্টআপে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কর অব্যাহতি, অনুদান, সহজ শর্তে ঋণ এবং ইক্যুইটি বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়া এখন সময়ের দাবি। জানতে চাইলে ই-ক্যাবের উদ্যোক্তা এবং স্টার্টআপ স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার জাহিদ আনন্দবাজারকে বলেন, আমাদের দেশে স্টার্টআপের সফলতা কাজে লাগাতে নতুন উদ্যোক্তাদের ঋণের সুবিধা দিতে হবে। অটোমেশন ব্যবহারের সুযোগ বাড়াতে হবে।
স্টার্টআপে বিভিন্ন সুবিধা দিতে এরই মধ্যে সরকার কাজ শুরু করেছে জানিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক আনন্দবাজারকে বলেন, ‘সোনার বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার অন্যতম পন্থা হলো স্টার্টআপ। আমরা এরই মধ্যে এ খাত নিয়ে কাজ শুরু করেছি।
অ্যাক্সেলারেটর প্রোগ্রাম এবং স্টার্টআপ ফান্ডের মাধ্যমে দেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে সহায়তা করা হচ্ছে। আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করা হয়েছে। আগামীতেও যাতে স্টার্টআপগুলো বেড়ে উঠতে পারে তার জন্য নীতিগত ও আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখা হবে।
আনন্দবাজার/শহক