চামড়া শিল্প ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ’ গঠনের তাগিদ
সাভারের হেমায়েতপুরের ট্যানারি শিল্পনগরী বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছিল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। তবে চামড়া শিল্পের উন্নয়নে সুপারিশ প্রদান ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে গঠিত টাস্কফোর্স বলছে, শিল্পনগরী বন্ধ করে দেয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। তবে চামড়া শিল্পের বিকাশকে সুসংহত এবং টেকসই করতে ‘চামড়া শিল্প ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ’ গঠনের পাশাপাশি সাভার ট্যানারি শিল্প এলাকার কার্যক্রম সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা পদায়নসহ বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাস্কফোর্স। শিল্পনগরীর সমস্যাগুলোর সমাধানে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে জোর দেয় টাস্কফোর্স।
ট্যানারি শিল্প বন্ধ করার বিষয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ট্যানারি পল্লীতে প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য সৃষ্টি হয়। আর ট্যানারি পল্লীর বর্জ্য শোধন ক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার ঘনমিটার। ফলে ১৫ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য কোনো ধরনের শোধন ছাড়াই নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।’ সাবের হোসেন যুক্তি দেখান যে, ‘সাভারস্থ এই ট্যানারি শিল্পের কঠিন বর্জ্য শোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। কঠিন বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে ভারী ধাতু ও ক্রোমিয়াম। ফলে এ ধরনের ভারী বর্জ্য কোনো ধরনের শোধন ছাড়াই পানিতে ফেলা হচ্ছে।’
সাভারের চামড়া শিল্পনগরী বন্ধে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ প্রসঙ্গে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেছেন, ট্যানারি শিল্প বন্ধ করার মতো পরিস্থিতি এখনো হয়নি। তবে বহির্বিশ্বে চামড়া শিল্পের বাজার ধরে রাখতে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের অনুকূলে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সার্টিফিকেট অর্জনসহ কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে তিনি সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানান। ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান বিবেচনা না করে চামড়া শিল্পের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণে ট্যানারি মালিকদের আহ্বান জানান মন্ত্রী।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ট্যানারিগুলোর অতিরিক্ত পানি ব্যবহারের ফলে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সিইটিপির কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয়। তবে সাভার ট্যানারি শিল্পনগরী বন্ধ করা কোনো সমাধান নয় বরং চামড়া শিল্পনগরীর বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানে জোর দিতে হবে। চামড়ার সঠিক ব্যবস্থাপনা ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে কাঁচা চামড়া যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। সভায় শিল্পনগরীতে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি স্টোরেজ নির্মাণের পাশাপাশি সিইটিপি’ও মেডিউলগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা, ইসিআর-৯৭-এর মানদণ্ড অনুযায়ী পানি ব্যবহার নিশ্চিত, বিসিক আইন অনুযায়ী ট্যানারি শিল্প এলাকায় জব ওয়ার্ক নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ঢাকার কাছে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরী স্থাপন প্রকল্প চলতি বছরের জুন নাগাদ শেষ করেছে সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়। দু’বছর মেয়াদি এই প্রকল্প উনিশ বছর পরে এসে শেষ হলেও তাতে পূর্ণ সক্ষমতার কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বা সিইটিপি এখনও নেই। আর সে কারণে পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীতে পড়ছে বিপুল বর্জ্য। সরকারের শিল্প সচিবও বলেছেন এ দাবি যৌক্তিক নয় কারণ বন্ধ করলে চামড়া শিল্প ও পরিবেশ-দুটিরই ক্ষতি হবে বলে মনে করেন তারা।
ট্যানারিগুলো একসময় নারায়ণগঞ্জে ছিল। ১৯৫১ সালের ৩ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ট্যানারি ঢাকার হাজারীবাগে আনা হয়। হাজারীবাগে ট্যানারিগুলো দিনে প্রায় ২১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলতো। এ ছাড়া চামড়ার উচ্ছিষ্ট বেড়িবাঁধের পাশে, খালে, জলাধারে ও রাস্তার পাশে ফেলা হতো। এ সমস্যা সমাধানের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালে চামড়াশিল্প নগর প্রকল্প নেয়। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১৭৬ কোটি টাকা, যা পরে বাড়তে বাড়তে এক হাজার ৭৯ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এ প্রকল্পের অধীনে সাভারের হেমায়েতপুরে ১৯৯ একরের কিছু বেশি জমি অধিগ্রহণ করে ১৫৪টি ট্যানারিকে প্লট দেওয়া হয়।
চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী, ২৫০ কোটি টাকা ট্যানারির মালিকদের ক্ষতিপূরণ এবং বর্জ্য পরিশোধনাগার, চামড়া উচ্ছিষ্ট ফেলার জায়গা বা ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণ ও অন্যান্য কাজের জন্য রাখা হয়েছিল ৬৫০ কোটি টাকার মতো। জমি দেওয়ার পর বিভিন্ন সময় বিসিক ট্যানারির মালিকদের সাভারে যাওয়ার সময় বেঁধে দেয়। তবে ট্যানারির মালিকেরা গরজ দেখাননি। তাঁরা বারবার বলছিলেন, সিইটিপি প্রস্তুত নয়।
সিইটিপি নির্মাণের জন্য ২০১২ সালের ১১ মার্চ একটি চীনা কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয় বিসিক। দরপত্র মূল্য ছিল ৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৪৭ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)। কাজ শেষের সময় ধরা হয়েছিল ১৮ মাস। আর ছয় মাস রাখা হয়েছিল সিইটিপি কার্যকর করে বুঝিয়ে দেওয়ার। কিন্তু চীনা ঠিকাদার কোম্পানি সিইটিপির কাজ শেষ করতে সময় নেয় নয় বছরের বেশি। যদিও শেষ পর্যন্ত সিইটিপি যথাযথ মান অনুযায়ী হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল ট্যানারিগুলোকে হাজারীবাগ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। বিচ্ছিন্ন করা হয় হাজারীবাগের কারখানার সেবা–সংযোগ। সাভারে চামড়াশিল্প নগরে ট্যানারি চালু হতেই পরিবেশদূষণের অভিযোগ ওঠে। অন্যদিকে হেমায়েতপুরের এই চামড়াশিল্প নগরী নিয়ে উদ্বেগের মধ্যেই ট্যানারিগুলোর ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে আরেকটি সিইটিপি তৈরি এবং কঠিন বর্জ্য শোধন ব্যবস্থাসহ আরও ব্যবসায়ীদের কারখানার জায়গা দিতে সেখানেই নতুন করে আরও ২০০ একর জমিতে নতুন একটি পল্লী স্থাপনের প্রাথমিক কার্যক্রমও শুরু হয়েছে।
আনন্দবাজার/এম.আর