ঢাকা | বৃহস্পতিবার
২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উন্নত দেশে ব্যাপক সুবিধা পায় সংবাদমাধ্যম

  • শিল্পের কাঠামোই পায়নি সংবাদপত্র
  • স্বীকৃতি পেলেও সুবিধা মেলেনি 

গোটা বিশ্বজুড়ে জটিল এক শিল্প হিসেবে পরিচিত সংবাদমাধ্যম বা ‘নিউজ মিডিয়া’ পুঁজিঘন হলেও আর দশটা শিল্পের মতো নয়। এ শিল্পে বিনিয়োগ করা যতটা সহজ মুনাফা তুলে আনা ততটাই কঠিন। গণযোগাযোগ শাস্ত্র মতে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব কেবল তথ্য বা খবর পরিবেশনই নয়, সেই তথ্য বা খবরকে বিক্রয়যোগ্য করে তোলার তাগাদা থাকে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সক্ষমতার নেপথ্য শক্তি এই বিনিয়োগ সাফল্য। প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী সংবাদমাধ্যমের ঐতিহ্যবাহী ও সনাতনী উদ্যোগ সংবাদপত্র একটি শিল্প। আজ থেকে অর্ধযুগের বেশি আগে (২০১৪) দেশে সংবাদপত্রকে সেবাশিল্প ঘোষণা করা হয়। তবে শিল্প হিসেবে কাঠামোগতভাবে শক্ত ভিতের ওপর এখনও দাঁড়াতে পারেনি। বরং দিন দিন রুগ্ণশিল্পে পরিণত হয়েছে।

সংবাদমাধ্যমে বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) বিভিন্ন সময়ে এ শিল্পকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে বিজ্ঞাপনের বাজার আর সংবাদমাধ্যমের ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে স্থানান্তরের কারণে দিন দিনই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এ খাত। সংবাদপত্রের করপোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা, নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাদ দেওয়াসহ বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর উৎসে কর (টিডিএস) ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ এবং উৎসস্থলে কাঁচামালের ওপর ৫ শতাংশের বদলে অগ্রিম কর (এআইটি) শূন্য শতাংশ করার দাবি জানিয়ে এসেছে নোয়াব।

মূলত, সেবা শিল্প হিসেবে স্বীকৃত সংবাদমাধ্যমের প্রথম লক্ষ্য বৃহত্তর পরিসরে দেশ ও জনগণের সেবা করা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর সাহায্য ও সহযোগিতা সেভাবে পায়নি সংবাদপত্র শিল্প। উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, মুনাফাকারী সাধারণ শিল্পগুলোর মতো সহযোগিতা পাচ্ছে না এ খাত। তবে অন্যান্য শিল্পের কাঁচামালের মতো সংবাদপত্রশিল্প তার প্রধান কাঁচামাল কাগজ, কালি, প্লেটসহ অন্যান্য উপকরণ শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানির সুযোগ পেলে এ খাতে বিনিয়োগে সফলতা পেতে পারতো।

বাংলাদেশে মিডিয়া খাতে বিনিয়োগ শুরু হয়েছে মূলত চলতি শতকের গোড়ার দিকে। বর্তমানে এ খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ বসুন্ধরা গ্রুপের। অনলাইন, ইংরেজি দৈনিকসহ আরো দুটি দৈনিকে তারা বিপুল বিনিয়োগ করেছে। যদিও মিডিয়াতে বিনিয়োগে সবচেয়ে সফল হিসেবে ধরা হয় ট্রান্সকম গ্রুপকে। ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা কিংবা নতুন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ট্রান্সকম গ্রুপের দুটি দৈনিক (প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার) জনপ্রিয়তার পাশাপাশি প্রভাবশালী হিসেবে পাঠক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তবে যমুনা, স্কয়ার বা হামিম গ্রুপের মতো অনেক প্রতিষ্ঠানের মিডিয়া খাতে বিনিয়োগ অনেক বেশি। পাশাপাশি আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, রূপায়ন গ্রুপ বিনিয়োগ করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে মিডিয়াখাতে যেভাবে বা যে পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে তা একেবারেই অপরিকল্পিত। আধুনিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করেই উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করে বসছেন। তোড়জোড় করে মিডিয়া চালু হওয়ার পরেই মুখ থুবড়ে পড়ছে। তবে যারা সত্যিকার অর্থেই মিডিয়া থেকে মুনাফা নিতে চান, মিডিয়াকে ব্যবসা হিসেবে গড়ে তুলতে চান তাদের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের বিষয়টি নিয়ে বেশি করে ভাবতে হবে। গেল দুই দশকে অর্ধশতাধিক সংবাদমাধ্যমে বিপুল অংকের অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন চিত্র দেখা গেলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিত্র অনেকটাই আলাদা। শুল্ক-করে ছাড় পাওয়ার মধ্য দিয়ে সংবাদপত্রগুলো যাতে আরো সংবাদ সংগ্রহের জন্য পুনর্বিনিয়োগ করতে পারে, সে জন্য উদ্যোগ নিয়েছে তারা। জনগণের তথ্য ও বিনোদন পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে তথ্যভিত্তিক সমাজ গঠনের অংশ হিসেবে বেসরকারি সংবাদপত্রগুলোকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর সরকার।

সংবাদপত্রে রাষ্ট্রীয় সহায়তার ক্ষেত্রে এগিয়ে ফিনল্যান্ড। দেশটি সংবাদপত্র বিক্রির আয় ছাড়াও বিজ্ঞাপন, নিউজপ্রিন্ট, ছাপাখানা ও ছাপাখানায় ব্যবহৃত সব ধরনের উপকরণকে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দিয়েছে। এছাড়া আঞ্চলিক ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোকেও ভর্তুকি দেয়া হয়। ফ্রান্স নিবন্ধিত সংবাদপত্রগুলোর ওপর হ্রাসকৃতহারে ভ্যাট আরোপ করে, সংবাদপত্রে বিভিন্ন পদে কর্মরতদের কর অব্যাহতি সুবিধা দিচ্ছে। এ ছাড়া যেসব সংবাদপত্র কম বিজ্ঞাপন পায়, তাদের সরাসরি ভর্তুকি দেওয়ার পাশাপাশি আধুনিক ছাপাখানা স্থাপন ও নতুন প্রযুক্তি বিনিয়োগে সহায়তা করছে।

ইউরোপের আরেক দেশ ইতালি নিউজপ্রিন্ট, কম্পোজিশন ও ছাপাখানার ওপর হ্রাসকৃতহারে ভ্যাট নেয়। সংবাদপত্র শিল্পের নেওয়া ঋণের সুদেও ভর্তুকি দেয় দেশটি। এ ছাড়া সাংবাদিকরা সমবায়ের মাধ্যমে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশ করলে সেখানেও ভর্তুকি দেয় দেশটির সরকার। সিঙ্গাপুরে নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে শুল্ক নেই, ভ্যাট রয়েছে ৭ শতাংশ; কাতারে শুধু শুল্ক রয়েছে ৫ শতাংশ। চীনে ৭.৫ শতাংশ শুল্ক, পাশের দেশ ভারতে নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর কোনো শুল্ক নেই। তা সত্ত্বেও সে দেশে সংবাদপত্রশিল্পে দুর্দশা চলছে। কংগ্রেস সরকারের দেওয়া ওয়েজবোর্ডে ভারতের সংবাদপত্র অফিসে কর্মরতদের বেতন বেড়েছে ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ।

ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড ও রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব জার্নালিজমের যৌথভাবে করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলো কর ছাড় দিয়ে সংবাদপত্রের করহার বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের সমান করা হয়েছে। সংবাদপত্র বিক্রির আয়ের পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের আয়কেও ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রচারসংখ্যা বাড়ানো ও ব্যবস্থাপনা খরচকেও কর-ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এভাবে প্রতিবছর ৯০ কোটি ডলারেরও বেশি রাজস্ব ছাড় দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যমতে, সারাদেশে নিবন্ধন করা পত্রিকার সংখ্যা তিন হাজার ১৬০টি। ঢাকা থেকে ৫০২টি ও মফস্বল থেকে ৭৭৭টি মিলিয়ে দৈনিক এক হাজার ৭৯টি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি মফস্বল থেকে অর্ধসাপ্তাহিক তিনটি, ঢাকা থেকে ৩৪৭টি ও মফস্বল থেকে ৮৫১টি মিলিয়ে সাপ্তাহিক এক হাজার ১৯১টি, ঢাকা থেকে ১৪৬টি ও মফস্বল থেকে ৬৮টিসহ পাক্ষিক ২১৪টি, ঢাকা থেকে ২৭৭টি ও মফস্বল থেকে ১৪৫টিসহ মাসিক পত্রিকা ৪৪২টি, ঢাকা থেকে পাঁচটি ও মফস্বল থেকে তিনটিসহ মোট দ্বিমাসিক পত্রিকা ৮টি, ঢাকা থেকে ১৮টি ও মফস্বল থেকে ১৩টিসহ মোট ত্রৈমাসিক পত্রিকা ৩১টি, চতুর্মাসিক একটি, ঢাকা ও মফস্বল থেকে ষান্মাসিক দুটি এবং বার্ষিক দুটি প্রকাশিত হয়।

আনন্দবাজার/এনএম

সংবাদটি শেয়ার করুন