হাইড্রোজেনকে অনেকেই বলেন ভবিষ্যতের জ্বালানি। তাদের দাবি, গাড়ি চালাতে ও বাসাবাড়িতে এই গ্যাস ব্যবহারের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব। হাইড্রোজেন অর্থনীতি সংকটে থাকা জ্বালানি খাতকে উদ্ধার করতে পারবে বলে আশা তাদের।
এরই মধ্য জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেনের ব্যবহার নিয়ে নতুন উদ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে। ৩৫০টির বেশি প্রকল্প চলমান রয়েছে হাইড্রোজেন নিয়ে। ২০৩০ সাল নাগাদ এই গ্যাসের পেছনে সর্বমোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০০ বিলিয়ন ডলারে।
তবে হাইড্রোজেন-বিরোধীরা অবশ্য বলছেন, ১৯৭০-এর দশক থেকেই এই গ্যাসে বিনিয়োগ নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা চলছে। কিন্তু হাইড্রোজেন গ্যাসের খামতির কারণে কোনো গবেষণাই হালে পানি পায়নি।
বাস্তবতা হলো, হাইড্রোজেন প্রযুক্তি বর্তমান কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ২০৫০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারবে। পরিমাণে কম হলেও বর্তমান বাস্তবতায় এইটুকু কার্বন নিঃসরণ কমানোও যথেষ্ট গুরুত্ব রাখে।
তেল-কয়লার মতো জ্বালানির প্রধান উৎস নয় হাইড্রোজেন। এটি মূলত শক্তিবাহক, অনেকটাই বিদ্যুতের মতো। ব্যাটারির মতো সংরক্ষণের মাধ্যম। একে উৎপাদন করতে হয়। নবায়নযোগ্য ও পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে পানি থেকে হাইড্রোজেনকে আলাদা করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি বেশ ব্যয়বহুল, তবে এর খরচ দিন দিন কমে আসছে।
অপরিচ্ছন্ন জীবাশ্ম জ্বালানি থেকেও হাইড্রোজেন তৈরি করা যায়। তবে প্রযুক্তির সাহায্যে কার্বন আলাদা করে না ফেললে এতে প্রচুর দূষণ হয়। হাইড্রোজেন অনেক জ্বালানির তুলনায় তুলনামূলক বেশি দাহ্য এবং ভারী। থার্মোডায়নামিকসের সূত্রানুসারে, প্রাথমিক জ্বালানিকে হাইড্রোজেনে এবং তারপর হাইড্রোজেনকে ব্যবহারযোগ্য শক্তিতে রূপান্তরিত করতে প্রচুর অপচয় হয়।
এখন প্রধানত সার তৈরিসহ বিভিন্ন শিল্পে এ গ্যাসের ব্যবহার হয়ে থাকে। ভারত শিগগিরই হাইড্রোজেনের জন্য নিলামের আয়োজন করবে। চিলি সরকারি জমিতে হাইড্রোজেন উৎপাদনের জন্য টেন্ডার ডেকেছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ ১২টির বেশি দেশে জাতীয় হাইড্রোজেন প্ল্যান্ট রয়েছে।
হাইড্রোজেন বিশেষায়িত বাজারগুলোকে সাহায্য করতে পারে। বিশেষ করে জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়া ও অতি উচ্চ তাপমাত্রা প্রয়োজন হয় যেসব শিল্পে, সেগুলোতে এই গ্যাস বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ৮ শতাংশের জন্য দায়ী ইস্পাত শিল্প। এই শিল্পে কাজ করতে হয় কয়লা পুড়িয়ে। বায়ুশক্তি দিয়ে কয়লাকে প্রতিস্থাপন করা না গেলেও হাইড্রোজেন দিয়ে করা যাবে। গত আগস্টে হাইড্রোজেন জ্বালানি দিয়ে তৈরি বিশ্বের প্রথম সবুজ ইস্পাত বিক্রি করেছে সুইডিশ প্রতিষ্ঠান হাইব্রিট।
তবে এত উত্তেজনার মধ্যে হাইড্রোজেন কী করতে পারে এবং কী করতে পারে না, তা স্পষ্টভাবে জেনে নেওয়া দরকার। জাপানি ও কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলো হাইড্রোজেনচালিত গাড়ি বিক্রি করতে আগ্রহী। কিন্তু মুশকিল হলো, ব্যাটারিচালিত গাড়ি প্রায় দ্বিগুণ জ্বালানিসাশ্রয়ী। কিছু ইউরোপীয় দেশ বাসাবাড়িতে পাইপের মাধ্যমে হাইড্রোজেন সরবরাহের আশা করছে। কিন্তু হিট পাম্প অনেক বেশি কার্যকর।
এছাড়াও কিছু কিছু পাইপ দিয়ে হাইড্রোজেন গ্যাস নিরাপদে সরবরাহ করা সম্ভব না। কিছু বড় জ্বালানি প্রতিষ্ঠান এবং তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসনির্ভর রাষ্ট্র সহ-উৎপাদ কার্বন ঠিকমতো ধরে না রেখেই হাইড্রোজেন তৈরি করতে চায়। কিন্তু তাতে কার্বন নিঃসরণ কমবে না।
এছাড়াও হাইড্রোজেনের জন্য আরেকটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হচ্ছে বাণিজ্যিক বাহন। দ্রুত রিফুয়েলিং সুবিধার জন্য হাইড্রোজেনচালিত লরি ব্যাটারিচালিত লরিকে পেছনে ফেলতে পারে। একটি আমেরিকান কোম্পানি হাইড্রোজেনচালিত লরির ওপর বিনিয়োগ করছে। হাইড্রোজেন থেকে তৈরি জ্বালানি বিমান ও জাহাজেও কাজে লাগানো যেতে পারে। একটি ফরাসি প্রতিষ্ঠান ইউরোপীয় ট্র্যাকে হাইড্রোজেনচালিত রেল চালাচ্ছে।
এসবের বাইরেও একসাথে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি সংরক্ষণ ও পরিবহনের জন্যও হাইড্রোজেন ব্যবহার করা যেতে পারে। সূর্যের আলো কিংবা বাতাস না থাকলে নবায়নযোগ্য গ্রিড কোনো কাজ করবে না। সেক্ষেত্রে ব্যাটারি বেশ কাজে আসবে। তবে নবায়নযোগ্য শক্তিকে যদি হাইড্রোজেনে রূপান্তরিত করা যায়, তবে একে কম খরচে দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যাবে এবং প্রয়োজনের সময় বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত করা যাবে। আমেরিকার ইউটাহতে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্যালিফোর্নিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য হাইড্রোজেন মজুদ করার পরিকল্পনা করছে।
এত বিশাল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের পর হাইড্রোজেন ব্যবহারের আরও নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার করা যেতে পারে। এই কর্মযজ্ঞের বেশিরভাগের দায়িত্ব বেসরকারি খাতের হলেও সরকারগুলোরও কিছু দায়িত্ব আছে।
সরকারগুলোর উচিত জ্বালানি হাইড্রোজেনের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা। হাইড্রোজেনের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
- সূত্র: দি ইকোনমিস্ট
আনন্দবাজার/শহক