পঞ্চাশ বছরে অর্জনের তালিকাটা বিশাল। তবে এর মাঝে কিছু অর্জন ঠিক সেভাবে আমাদের চোখে পড়ে না। অথচ গুরুত্বের বিচারে ভাবতে গেলে কোনও অংশে কম নয় সেগুলো। ব্রয়লার মুরগির কথাই ধরুন। বাংলাদেশের নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা পূরণে কী দারুণ ভূমিকা রেখে চলেছে প্রাণীটি। অথচ এই ব্রয়লারেও পড়েছে বিষের থাবা। ব্যবহার করা হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। তাতে উপকার তো দূরে থাক, উল্টো মারাত্বক সব রোগ দাঁনা বাঁধছে শরীরে। কমছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও। আর এই ঝুঁকি এড়িয়ে নিরাপদ ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে কাজ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। ইতোমধ্যে তারা সাফল্যও পেয়েছেন।
রাবির গবেষকদের উৎপাদিত অ্যান্টিবায়েটিকমুক্ত ব্রয়লার মাংস বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে গ্রিন ব্রয়লার। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যা একটি অন্যরকম সুসংবাদ বটে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্সেস বিভাগের দুই শিক্ষক ড. শরিফুল ইসলাম ও ড. হাকিমুল হকের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী গবেষণাকাজটি করছেন। গত তিন বছর ধরে তারা এ গবেষণা করছেন। প্রথম পর্যায়ে ২৫০টি মুরগি দিয়ে গবেষণা শুরু করেন। সর্বশেষ পাঁচশ ব্রয়লার মুরগির ওপর গবেষণা চালান।
গবেষকরা জানান, খামারিদের মতো তারাও ভ্যাকসিন ব্যবহার করেন। তবে রোগ-প্রতিরোধ ও দ্রুত বৃদ্ধির জন্য বাজারের যে অ্যান্টিবায়োটিক তা ব্যবহার করেন না তারা। পরিবর্তে প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত বিভিন্ন উদ্ভিদের নির্যাস ব্যবহার করছেন গবেষকরা। সাধারণ ব্রয়লারের মতো এসব মুরগিও দ্রুত বাড়ে।
সাধারণত ২৫-২৭ দিন বয়সের একটি গ্রিন ব্রয়লারের ওজন হয় দেড় থেকে দুই কেজি। স্বাদ ও মানের দিক থেকে সাধারণ ব্রয়লারের চেয়েও ভালো বলে দাবি গবেষকদের।
গবেষক ড. হাকিমুল হক বলেন, অন্য প্রাণীদের জন্য ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এর পরিবর্তে আমরা উদ্ভিদের নির্যাস ব্যবহার করি। কৃমিনাশক ওষুধের পরিবর্তে নিমপাতা ও দ্রুত বৃদ্ধির জন্য গ্রোথ হরমোনের পরিবর্তে সজিনার পাতা ব্যবহার করি। সজিনা পাতায় অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও গ্রোথ বর্ধক গুণ রয়েছে যা মুরগির রোগ প্রতিরোধেও কাজ করে।
এ ছাড়া শীতকালে মুরগির শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে আদা খাওয়ানো হয় বলেও জানান ড. হাকিমুল হক।
গবেষকরা বলছেন, অ্যান্টিবায়োটিকমুক্ত ব্রয়লারের মৃত্যুর হার কম। গবেষক দলের সদস্য ড. শরিফুল ইসলাম বলেন, সাধারণ ব্রয়লারের মতো গ্রিন ব্রয়লার ২৭ দিনে ১.৭ থেকে ১.৯ কেজি হয়। ৩২ দিনে প্রতিটি মুরগির ওজন দুই কেজি ছাড়ায়। ৩৬তম দিনে পৌনে তিন কেজি থেকে তিন কেজি হয়।
গ্রিন ব্রয়লারের মৃত্যুর হার দুই শতাংশের কম বলেও দাবি এ গবেষকের। তিনি বলেন, আমরা প্রথম ধাপে ২৫০টি মুরগির ওপর এক্সপেরিমেন্ট করি। যেখানে মাত্র ৫টি মুরগি মারা যায়। সর্বশেষ ৫০০টি মুরগির মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল দুই শতাংশেরও কম।
ব্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে ড. ইসলাম বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করলেও ব্যবস্থাপনায় খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখতে হয়। অন্য খামারিরা যেখানে দুই-তিন দিন পর পরিষ্কার করে সেখানে আমাদের প্রতিদিনই পরিষ্কার করতে হয়। খেয়াল রাখতে হয় যাতে পরিবেশ স্যাঁতস্যাঁতে না হয়। এ কারণে একটু বাড়তি জনবলের প্রয়োজন পড়ে।
ভেটেরিনারি বিভাগের শিক্ষকদের উৎপাদিত ব্রয়লার মুরগির মাংসের গ্রাহক এখন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকরা। এদের মধ্যে আছেন ফার্মেসি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আজিজুর রহমান শামীম। তিনি জানান, গবেষণায় দেখা গেছে সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ব্রয়লার ও গরুর মাংসেও চলে যাচ্ছে। যা রান্নার পরও নষ্ট হচ্ছে না। ফলে মানুষ মাংসের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিকও খাচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক এমনিতে ডোজ হিসেবে নিতে হয়। কিন্তু মুরগি থেকে অ্যান্টিবায়োটিকের তো আর ডোজ থাকছে না।
আজিজুর রহমান আরও বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক আন্ডার ডোজ হিসেবে গ্রহণে দুটি ঘটনা ঘটে। হয়, এটি পরে আর কোনও কাজ করবে না। বা আমাদের শরীরে থাকা রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুগুলো এ অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। এতে দেখা দিতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্স। এ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকযুক্ত ব্রয়লার খেলে গর্ভবতী ও শিশুদের নানা সমস্যা সৃষ্টি হয় বলেও জানান তিনি।
ইতোমধ্যে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্রয়লারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে উল্লেখ করে আজিজুর রহমান আরও বলেন, আমাদের দেশের ব্রয়লারের মাংস অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য হওয়ায় সকল শ্রেণির মানুষের খাদ্য তালিকায় এটি থাকে। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে ভোক্তাদের বড় একটা অংশ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারাচ্ছে।
গবেষকরা বলছেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে জেলা পর্যায়ে তারা খামারিদের অ্যান্টিবায়োটিমুক্ত ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনের জন্য প্রশিক্ষণ দিতে প্রস্তুত। এতে করে আগামীর খাদ্য হিসেবে গ্রিন ব্রয়লার হয়ে উঠতে পারে আমিষের রোল মডেল।
আনন্দবাজার/শহক