পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) নতুন কোম্পানিগুলো প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিওর) মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের জন্য আবেদন করেছে। কিন্তু কমিশনের অনুমোদন না পাওয়ায় আটকে আছে অন্তত ৩০ কোম্পানির ব্যবসা সম্প্রসারণ, ঋণ পরিশোধ ও অবকাঠামো নির্মাণ। ফলে ব্যাহত হচ্ছে কোম্পানির উন্নয়ন। থমকে আছে কর্মসংস্থানও।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিনিয়তই দেশের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের গড় আয়ু, আয় এবং প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। ঠিক বিপরীত চিত্র দেশের পুঁজিবাজারে। অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের অবদান বাড়ার পরিবর্তে কমছে। এদিকে দেশের উন্নয়নের জন্য উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে। ব্যাংক থেকে সাধারণত স্বল্প মেয়াদী ঋণ নেয় উদ্যোক্তারা। কারণ সুদ দিতে হয়। আর বিনা সুদে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থ সংগ্রহ করে পুঁজিবাজার থেকে। ভারত, পাকিস্তান, চীনের মত দেশগুলোতে আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন দিচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশের কমিশন দিচ্ছে না।
এতে করে একদিকে কোম্পানিগুলোর অর্থের অভাবে তাদের চাহিদা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে ভালো ভালো কোম্পানিও আসছে না। তাতে বিনিয়োগকারীরা দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে পুঁজি হারাচ্ছেন। প্রতিনিয়তই নি:স্ব হচ্ছেন। তাই পুঁজিবাজারের স্বার্থে ভালো কোম্পানির আইপিও দ্রুত অনুমোদনের দাবি সংশ্লিষ্টদের।
আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ নিয়ে কোম্পানির উন্নয়ন করতে চায় ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড, ডেল্টা হসপিটাল, শামসুল আলামিন রিয়েল স্টেট, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন, ই-জেনারেশন, এএফসি হেলথ লিমিটেড, লুব-রেফ বাংলাদেশসহ ত্রিশটিরও বেশি কোম্পানির উদ্যোক্তারা।
এছাড়াও আইপিওর দীর্ঘসূত্রিতায় পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং অ্যাপোলো হসপিটাল আইপিওর আবেদন প্রত্যাহার করেছে। বাংলালিংক ও নেসলেসহ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। দেশীয় ভালো কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসছে না।
আর তাতে গত দশ বছরে অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের অবদান বাড়ার পরিবর্তে উল্টো কমছে। অথচ পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে তাদের অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারে অবদান ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত। আর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জিডিপিতে ১ শতাংশের নিচে অবদান রয়েছে পুঁজিবাজারের। এই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন চান উদ্যোক্তারা।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজার সম্প্রসারণের জন্যই প্রয়োজন নতুন আইপিও’র অনুমোদন। পুঁজিবাজারে যত বেশি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হবে।দেশের অর্থনীতির জন্য ততই সুসংবাদ। তবে তা হতে হবে ভালো কোম্পানি। দুর্বল কিংবা পচা কোম্পানি নয়।
তিনি বলেন, বাজারে এখনো ভালো কোম্পানির শেয়ারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি শেয়ার ছাড়া বিনিয়োগ করার মতো শেয়ার নেই। কমিশনের উচিত ভালো কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেওয়া।
নাম না প্রকাশের শর্তে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি বলেন, ডিসক্লোজার ভিত্তিক আইপিও’র অনুমোদন ও প্লেসমেন্টধারী শেয়ারহেল্ডারদের শেয়ার বিক্রির লক ইন আইনসহ নতুন কোম্পানির আইপিওর অনুমোদনের সব সূচকই ইতিবাচক রয়েছে, কিন্তু তারপরেও কমিশন নতুন আইপিওর অনুমোদন দিচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘এনজেল ইনভেস্টর’ (প্লেসমেন্টধারীদের) শেয়ার বিক্রিতে পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে ৩ মাস থেকে সর্বোচ্চ ১ বছর লক ইন রয়েছে। এর মধ্যে মিয়ানমারে ৩ মাস, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় ৬ মাস। এছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, চীন, থাইল্যান্ডে প্লেসমেন্টধারীদের লক ইন এক বছর। এই ‘এনজেল ইনভেস্টরদের’ শেয়ার বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আমাদের দেশেও এক বছর। কিন্তু তারপরও চলতি বছরের ১২ মার্চের পর আইপিও অনুমোদন (রিং সাইন টেক্সটাইলের আইপিওর অনুমোদন দেওয়া হয়) বন্ধ রয়েছে।
সাত বছরে পুঁজিবাজারে আসা কোম্পানির অবস্থান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে ৮৭টি কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি কোম্পানির শেয়ার ফেসভ্যালুর (অভিহিত মূল্য ১০টাকা) নিচে অবস্থান করছে। যা শতাংশের হারে ১১ শতাংশ। অথচ ভারতে একটি স্টক এক্সচেঞ্জে সেপ্টেম্বর ২০১৮ হতে মে ২০১৯ সালে ৫০ টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ২৪টি কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে।
একইভাবে মালয়েশিয়াতে ২০১৮ সালের মার্চ হতে ২০১৯ সালের মে পর্যন্ত সময়ে ২০টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ৪টি কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে। হংকংয়ে জুলাই ২০১৮ থেকে মে ২০১৯ সালে ১৬০টি কোম্পানি তালিকাভুক্তি হয়েছে। ৮০টি কোম্পানি শেয়ারের দাম অভিহিত মূল্যের নিচে অবস্থান করছে। তারপরও নতুন নতুন কোম্পানির আইপিওর অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ আইপিওর অনুমোদন বন্ধ রয়েছে।
আনন্দবাজার/ইউএসএস