মুসলিম বিবাহের নিবন্ধন ‘নিকাহনামা’ ফরম প্রায় ৫০ বছর পর সংশোধন করা হচ্ছে। উচ্চ আদালতের আদেশে ফরম থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে নারীর প্রতি অবমাননাকর প্রশ্ন ‘কন্যা কুমারী’ কি না। নিকাহনামায় বরের স্ত্রী কতজন বর্তমান আছে, তা-ও জানাতে হবে সংশোধিত ফরমে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এরই মধ্যে খসড়া ফরম প্রস্তুত করেছে। তারা খসড়া ফরমটি আইন মন্ত্রণালয় পাঠিয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) আইন, ১ঌ৭৪-এর যে বিধিমালা ২০০৯ সালে প্রণয়ন করা হয়, তাতে নিকাহনামা ফরমে (বাংলাদেশ ফরম নম্বর ১৬০১) মোট ২৫ ধরনের তথ্য চাওয়া হয়। ওই ফরমের ৫ নম্বর দফায় তথ্য চাওয়া হয়েছে—‘কন্যা কুমারী, বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্ত নারী কি না?’ হাইকোর্ট এক রায়ে এই দফাটি পরিবর্তন ও সংশোধন করতে বলেছেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন ফরমে দফাটি সংশোধন করে ‘কন্যা অবিবাহিত, বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্ত নারী কি না?’ সেই তথ্য চাওয়া হয়েছে নতুন ফরমে। বর্তমান নিকাহনামা ফরমের ২১ নম্বর দফায় জানতে চাওয়া হয়েছে, ‘বরের কোনো স্ত্রী বর্তমানে আছে কি না এবং থাকিলে অন্য বিবাহে আবদ্ধ হইবার জন্য বর ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ মোতাবেক সালিসি কাউন্সেলের অনুমতি লইয়াছে কি না?’
নতুন খসড়া ফরমে এই অনুচ্ছেদে জানতে চাওয়া হয়েছে, ‘বর বিবাহিত, অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত, বিপত্নীক কি না? স্ত্রী থাকিলে কতটি এবং অন্য বিবাহে আবদ্ধ হইবার জন্য বর ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ মোতাবেক সালিসি কাউন্সিলের অনুমতি লইয়াছে কি না?’ এ ছাড়া যে কজন স্ত্রী বর্তমান থাকবে, তাঁদের বিষয়েও তথ্য দিতে হবে নতুন ফরমে।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) জনস্বার্থে ‘নিকাহনামা সংশোধন’ চেয়ে ২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে একটি মামলা (রিট পিটিশন নং ৭৮৭৮/২০১৪) করে। পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টের বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর এ বিষয়ে রায় দেন। রায়ে নিকাহনামা ফরম থেকে ‘কুমারী’ শব্দ বাদ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, কুমারী শব্দ বাদ দেওয়ার পাশাপাশি কাবিননামার ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে বরের বর্তমান বৈবাহিক অবস্থা উল্লেখ করারও নির্দেশ দেন আদালত। ফলে, পূর্ণাঙ্গ রায়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নাইমা হায়দার বলেন, নিকাহনামার ২১ ও ২২ নম্বর দফায় বরের বর্তমানে কোনো বিবাহ বলবৎ আছে কি না, কেবল সে বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। কিন্তু বর তালাকপ্রাপ্ত বা বিপত্নীক অথবা কুমার কি না, এ বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়নি। অন্যদিকে, ৫ নম্বর দফায় কন্যা তালাকপ্রাপ্ত বা বিধবা কি না, পাশাপাশি কন্যা আগে কোথাও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন কি না—এ ধরনের তথ্য চাওয়া হয়েছে, যা অপমানজনক, বৈষম্যমূলক, পক্ষপাতদুষ্ট ও সংবিধানের পরিপন্থী।
উচ্চ আদালতের রায়ে নিকাহনামার ফরম থেকে নারীর প্রতি অবমাননাকর শব্দ তুলে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে উল্লেখ করে ব্লাস্টের আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা বলেন, সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পিবিআই নতুন ফরমটি খসড়া করে গত ৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠায়। সেখান থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। খসড়া ফরমে পিবিআইপ্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার স্বাক্ষর করেছেন। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, তালাকপ্রাপ্ত নারীদের পুনঃ বিবাহের ক্ষেত্রে অনেক সময় তালাকপ্রাপ্ত নারী তথ্য গোপন করে ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে কুমারী কথাটি লেখে, আবার অনেক ক্ষেত্রে বর ও কনেপক্ষের পারস্পরিক সম্মতিতে কন্যা তালাকপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও ‘কুমারী’ উল্লেখ করে নিকাহনামা ফরম পূরণ করেন। তবে পরবর্তী সময়ে এসব ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বিয়ের পর কোনো বিরোধ হলে নিকাহনামায় কুমারী লেখায় বরপক্ষ কনের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ উল্লেখ করে মামলা করে। এসব ক্ষেত্রে নারীরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হন। এ জন্যও ফরমটি সংশোধন করা প্রয়োজন।