ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লবনাক্ততায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে উপকূ‌লের নারীরা

লবনাক্ততায় খুলনার উপকূলীয় উপ‌জেলা কয়রা, দা‌কোপ, ব‌টিয়াঘাটা ও পাইকগাছার ‌নারীরা নানা রো‌গে আক্রান্ত হ‌চ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফ‌লে সৃষ্টি প্রাকৃ‌তিক দু‌র্যো‌গে ক্ষ‌তিগ্রস্ত হ‌য়ে উপকূ‌লের নারীরা জী‌বিকা নির্বা‌হে নদী‌তে মাছ ধরছেন, মৎস‌্য ঘে‌রে কাজ কর‌ছেন। পাশাপা‌শি প্রতি‌নিয়ত লবন পা‌নির সংষ্প‌র্ষে নানা কাজ করতে বাধ‌্য হ‌চ্ছেন। দীর্ঘক্ষণ লবন পা‌নির সংষ্প‌র্ষে থাকার ফ‌লে নারী‌দের প্রজননতন্ত্রের সমস্যা, অকাল গর্ভপাতসহ জরায়ুর সমস‌্যা বৃ‌দ্ধি পা‌চ্ছে। এছাড়া চর্ম‌রোগ ও সাদাস্রাব রোগীর সংখ‌্যা আশঙ্কাজনক হা‌রে বেড়ে চ‌লে‌ছে।

এ‌দি‌কে, কি‌শোরী ও নারীরা স‌চেতনতার অভা‌বে প‌রিবার ও চি‌কিৎস‌কের কা‌ছে সমস‌্যার কথা যথাসম‌য়ে না বলায় রোগ জ‌টিল হ‌চ্ছে। জরায়ু কে‌টে ফেলার মত ঘটনাও ঘট‌ছে। কিশোরী ও নারীদের সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণের পাশাপা‌শি বিকল্প কর্মসংস্থান ও লবণাক্ততার আগ্রাসন রোধে সুনির্দ্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের দা‌বি নাগ‌রিক নেতা‌দের।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জলবায়ু প‌রিবর্তনের ফ‌লে উপকূ‌লে নানা প্রভাব পড়‌ছে। সিডর, আইলা, বুলবুল, আম্পান, সিত্রাং, মোখার মতো প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত হ‌য়ে‌ছে উপকূল। এছাড়াও নদী ভাঙ্গন, জলবদ্ধতা ও অতিবৃষ্টির প্রকোপে ক্ষ‌তিগ্রস্থ উপকূলবা‌সি। ফলে বার-বার বিপদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে উপকূলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পরিবারের সদস্যদের। প্রতিনিয়ত লড়াই-সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় উপকূলের মানুষদের। জী‌বিকার তা‌গি‌দে পুরুষ‌দের পাশাপা‌শি নারী‌রাও বি‌ভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কা‌জে নি‌য়ো‌জিত হ‌চ্ছে। নারী-পুরু‌ষের দিনরাত সংগ্রামে জোগাড় হয় দু’মুঠো খাবার। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাবে ক্ষতির হাত থেকে বাদ যাচ্ছে না কৃষকের ফসল, মৎস‌্য সম্পদ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা এবং বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। অতিরিক্ত গরমে মারা যাচ্ছে তাদের ঘেরের মাছ। আবার কখনো ভারি বৃষ্টিপাতে তলিয়ে যাচ্ছে মৎস‌্য ঘের।

দা‌কোপের কালাবগীর র‌হিমা (ছদ্মনাম) জানান, নদী ভাঙ্গ‌নে বসতভিটা হা‌রি‌য়ে‌ছে। এখন স্বামী-স্ত্রী মি‌লে নদী‌তে জাল টে‌নে মাছ ধ‌রে সংসার চালান। তার সারা শরীরসহ গোপনাঙ্গ চুলকায়। জরায়ুর সমস‌্যাও র‌য়ে‌ছে।

কয়রা উপ‌জেলার ৪ নং কয়রা গ্রা‌মের নিলুফা জানান, স্বামী রে‌খে অন‌্যত্র চ‌লে গে‌ছে। এখন সংসার চালা‌তে নদী‌তে মাছ ও কাঁকড়া ধ‌রেন। সারা শরীর চুলকায়। ম‌হিলা‌দের গোপন রো‌গে আক্রান্ত।

একই উপ‌জেলার কাটকাটা এলাকার ঝর্ণা ব‌লেন, প্রায় প্রতিবছর নদীর বাঁধ ভে‌ঙে এলাকা প্লা‌বিত হয়। প্রাকৃ‌তিক দু‌র্যো‌গে ক্ষ‌তিগ্রস্ত হই। স্বামীর পাশাপা‌শি বি‌ভিন্ন কাজ ক‌রে সংসার চালা‌তে হ‌চ্ছে। নদী‌তে মাছ ধ‌রি। চর্ম‌রো‌গে আক্রান্ত হ‌য়ে‌ছি। এছাড়া জরায়ুর সমস‌্যাও র‌য়ে‌ছে।

নাম প্রকা‌শে অ‌নিচ্ছুক দেয়াড়া গ্রা‌মের এক নারী ব‌লেন, দীর্ঘ‌দিন জরায়ুর সমস‌্যায় আক্রান্ত ছিলাম। একপর্যা‌য়ে জরায়ু কে‌টে ফেলা হ‌য়ে‌ছে। এরপ‌রেও নানা জ‌টিলতায় ভুগ‌ছেন ব‌লে জানান তি‌নি।

কয়রা উন্নয়ন সম্বনয় সংগ্রাম কমিটির সভাপতি প্রভাষক বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, জলবায়ু প‌রিবর্ত‌নের ফ‌লে সৃষ্ট প্রাকৃ‌তিক দু‌র্যো‌গে বার বার উপকূল ক্ষ‌তিগ্রস্ত হ‌য়ে‌ছে। বসতবা‌ড়ি হা‌রি‌য়ে নিঃস্ব হ‌য়ে‌ছে উপকূ‌লের হাজার হাজার প‌রিবার। জীবিকার তাগি‌দে নারীরাও সম্পৃক্ত হ‌য়ে‌ছে ঝুঁ‌কিপূর্ণ কা‌জে। এছাড়া নিরাপত্তাহীনতা ও পরিবারের বোঝা মনে করায় অল্প বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় এখানকার অধিকাংশ মেয়ে শিশুদের। অল্প বয়সে গর্ভধারণের ফলে বাড়ছে মা ও শিশু মৃত্যু। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ায় বিগত দিনের চেয়ে নদ-নদীতে এবং খাল বিলের পানিতে বেড়েছে লবণাক্ততা। লবণাক্ত পানিতে কাজ করায় নারীরা জরায়ুর রোগ, গর্ভপাত, স্পর্শকাতর স্থানে ক্ষতসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

কয়রার আং‌টিহারা ক‌মিউ‌নি‌টি ক্লি‌নি‌কের ক‌মিউ‌নি‌টি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (‌সিএইচ‌সি‌পি) সাধন কুমার ব‌লেন, এখানকার অ‌ধিকাংশ নারীরা নদী‌ ও নোনাপা‌নির ঘের থে‌কে মাছ ও কাঁকড়া আহরণ ক‌রে। ক্লি‌নি‌কে প্রতি‌দিন পর্যাপ্ত চর্ম‌রোগী সেবা নি‌তে আ‌সেন। এছাড়া জরায়ুর সমস‌্যাসহ নানা রো‌গে আক্রান্ত নারী রোগীর সংখ‌্যা অ‌নেক বৃ‌দ্ধি পে‌য়ে‌ছে।

দা‌কোপ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ সুদীব বালা বলেন, বে‌শিক্ষণ পা‌নি‌তে থাক‌লে যে কা‌রোরই চর্ম‌রোগ হ‌তে পা‌রে। লবন পা‌নির সংষ্প‌র্ষে দীর্ঘ সময় থাক‌লে নারী‌দের সাদাস্রাবের সমস‌্যা বে‌শি হয়। এছাড়া জরায়ুতে আক্রান্ত হ‌য়ে জ‌টিলতা দেখা দি‌তে পা‌রে। ত‌বে এলাকার নারীরা লবনপা‌নির সা‌থে অ‌ভি‌যো‌জিত হ‌য়ে যাওয়ায় রোগ প্রতি‌রোধ কিংবা সহ‌্য করার ক্ষমতা অ‌নেক বে‌শি। ফ‌লে আমা‌দের কা‌ছে কম রোগী আ‌সে।

কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ রেজাউল করিম বলেন, লবনাক্ততার ফ‌লে চর্মরোগের পাশাপা‌শি ছত্রাকজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এসব অঞ্চলের নারীরা। লবন পা‌নির সংষ্প‌র্ষে থাক‌লে নারী‌দের জরায়ু‌র সমস‌্যা হ‌ওয়ার ঝুঁ‌কি থাকে। আমরা সাধ‌্যমত সেবা দি‌য়ে যা‌চ্ছি। ত‌বে চিকিৎসক ও স্বাস্থ‌্যকর্মী সংকটের পাশাপা‌শি এ অঞ্চলের নারী‌দের স‌চেতনতার অভা‌বে কিছুটা জ‌টিলতা বাড়‌ছে।

সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের অকাল গর্ভপাত, প্রজননতন্ত্রের সমস্যা, ঋতুচক্রজনিত সমস্যাসহ জরায়ু কেটে ফেলার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এটি কেবল উপকূলের নারীদের স্বাস্থ্যহানি ঘটাবে না, বরং জাতীয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তাই উপকূলীয় এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার উপকরণ, ওষুধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কিশোরী ও নারীরা যাতে পরিবার এবং চিকিৎসকের কাছে নিরাপদে সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারেন; এরকম সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। একইসঙ্গে বিকল্প কর্মসংস্থান ও লবণাক্ততার আগ্রাসন রোধে সুনির্দ্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে

সংবাদটি শেয়ার করুন