প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগের টিকার গবেষণা সফল হয়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএম) লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের গবেষকরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরনের বিরুদ্ধেই কার্যকর।
তারা জানান, এই টিকা ডেঙ্গু ভাইরাসের ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪; চারটি ধরনের বিরুদ্ধেই কার্যকর। এক ডোজের ডেঙ্গু টিকা টিভি-০০৫ মূল্যায়ন করে দেখা যায়, এটি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের প্রয়োগ নিরাপদ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম।
ডেঙ্গু টিকার এই সফল পরীক্ষা নিয়ে বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক সাময়িকী ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। টিকার নাম দেওয়া হয়েছে টিভি-০০৫ (টেট্রাভেলেন্ট)। আইসিডিডিআর,বি এবং ইউভিএম-এর ভ্যাকসিন টেস্টিং সেন্টারের (ভিটিসি) গবেষকরা ২০১৫ সালে ‘ডেঙ্গু ইন ঢাকা ইনিশিয়েটিভ (ডিডি)’ এই গবেষণাটি শুরু করে। এর লক্ষ্য ছিল ডেঙ্গু টিকার উন্নয়নে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, ল্যাবরেটরি পরীক্ষণ অবকাঠামো এবং ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অধ্যয়ন সংশ্লিষ্ট গবেষণায় প্রয়োজনীয় সক্ষমতা তৈরি করা হয় আইসিডিডিআর,বিতে। ল্যানসেটে প্রকাশিত এই গবেষণাটি একটি দৈবচয়নভিত্তিক এবং ফেজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এর মাধ্যমে টিভি-০০৫ টেট্রাভ্যালেন্ট লাইভ-অ্যাটেনুয়েটেড ডেঙ্গু টিকার নিরাপত্তা, ইমিউনোজেনিসিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির সক্ষমতা, এবং তিন বছর পর্যন্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার স্থায়িত্বের অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়েছে।
দীর্ঘ ৭ বছরের চেষ্টায় গবেষকরা (২০১৬ সাল থেকে শুরু করে) বিভিন্ন বয়সের (এক থেকে ৪৯ বছর) ১৯২ জন স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণকারীকে চারটি ভাগে ভাগ করে (তিন:এক) অনুপাতে টিভি-০০৫ টিকা বা প্লাসিবো প্রদান করেন। পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেন। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, টিকা দেওয়ার পরে বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। যারা আগে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের শরীরে অ্যান্টিবডির পরিমাণ ছিল বেশি। এখন পর্যন্ত টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের কোনো ঘটনা শনাক্ত করা যায়নি। উল্লেখ্য, ইউভিএমের ভ্যাকসিন টেস্টিং সেন্টার ২০০৯ সাল থেকে এই টিকার মূল্যায়ন করে আসছে। ইউভিএম টিমের নেতৃত্বে রয়েছে প্রফেসর বেথ কির্কপ্যাট্রিক।
প্রধান গবেষক হিসেবে আইসিডিডিআর,বি গবেষকদের মধ্যে রয়েছেন জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী রাশিদুল হক এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন মো. শফিউল আলম, সাজিয়া আফরিন ও মো. মাসুদ আলম। রাশিদুল হক বলেন, ‘একটি কার্যকর এবং টেট্রাভালেন্ট ডেঙ্গু টিকা বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণে টিভি-০০৫ টিকার গবেষণা করতে পেরে আমরা গর্বিত এবং আশা করি আমাদের কাজ ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে একটি কার্যকর টিকা প্রাপ্তি ত্বরান্বিত করবে। ‘টিভি-০০৫ একমাত্র একক ডোজের টেট্রাভ্যালেন্ট ডেঙ্গু টিকা, যা এই টিকাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এটি ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের সব কয়টির বিরুদ্ধেই ইমিউন রেসপন্স তৈরি করে, যা যে কোনো টেট্রাভ্যালেন্ট ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ,’ যোগ করেন কির্কপ্যাট্রিক (ইউভিএম)৷ ডেঙ্গু একটি মশা বাহিত ভাইরাস যা বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে একটি বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির মৃদু লক্ষণে জ্বর এবং হাড়ের ব্যথা হয় এবং গুরুতর ক্ষেত্রে শক, রক্তপাত এবং অনেকক্ষেত্রে মৃত্যুও ঘটে। সাধারণত ডেঙ্গুর চারটি ধরন (ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩, ডেন-৪) বা সেরোটাইপ একক বা সম্মিলিতভাবে সক্রিয় থাকতে পারে।
উল্লেখ্য, একজন মানুষকে যে কোনো সেরোটাইপই অসুস্থ করতে পারে। তবে অন্য কোনো সেরোটাইপ দিয়ে দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হলে আক্রান্ত ব্যক্তির অবস্থা গুরুতর হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। বাংলাদেশে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটছে। সম্প্রতি এর আকার এবং তীব্রতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। চলতি বছরের চলমান ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুতর। সারা দেশে গত ২৫ সেপ্টেম্বর এক লাখ ৯০ হাজার ৭৫৮ জন ডেঙ্গু শনাক্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ৯২০ জনের বেশি মারা গেছেন।