- পকেট ভারী হচ্ছে দুষ্টদের
- নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা
দুষ্টুদের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুঁজিবাজার। রেগুলেটরদের কঠোর নিয়মেও বাজার থেকে এদের সরানো যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত বেশকিছু কোম্পানির শেয়ার দর অস্বাভাবিক উত্থান পতন হচ্ছে। এতে দুষ্টদের পকেট ভারী হলেও নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারী। তেমনিই মুন্নু এগ্রো এন্ড জেনারেল মেশিনারির শেয়ার দুষ্টুদের পাল্লায় পড়েছে বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, কোম্পানিটির শেয়ার দর লাগামহীন ছুটছে। অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি ইতোমধ্যে সবাইকে চিন্তায় ফেলেছে। বিষয়টি ভালো ভাবে নেয়নি রেগুলেটরা। অপরদিকে শেয়ারটির দর কেন বাড়ছে ব্যাখ্যা নেই কোম্পানিটির (মুন্নু এগ্রো এন্ড জেনারেল মেশিনারি) কর্তৃপক্ষের কাছে। গত দুই মাসে মুন্নু এগ্রো এন্ড জেনারেল মেশিনারির শেয়ার দর ৩০০ টাকা বেড়েছে। শেয়ার বৃদ্ধির প্রসঙ্গে মতিঝিলের নামি দামি পাঁচ সিকিউরিটিজ হাউজের বিনিয়োগকারীরা বলছেন, মুন্নু এগ্রো এন্ড জেনারেল মেশিনারির শেয়ার দর সামনে আরও বাড়বে। কেন বাড়বে, সেটা বলতে পারছেন না। তাদের ওইসব কথা শুনে অনেকেই অতি উচ্চ দরে শেয়ারটি কিনছে। যদিও কথাগুলো ভিত্তিহীন।
এর আগে ২০১০ সালের ধসের পর বা গত এক যুগে পুঁজিবাজারে অনেক কোম্পানি শেয়ার দর আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। সময়ের পালাক্রমে সেই কোম্পানিগুলোর শেয়ার শুকিয়ে গেছে। কারণ কৃত্রিমভাবে শেয়ার দর যতোই বাড়ুক, একদিন তার আসল রূপে ফিরবে, এটাই স্বাভাবিক। পুঁজির নিরাপত্তা স্বার্থে বিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা সব সময় বলে আসছেন বুঝে, শুনে ও বিশ্লেষণে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করতে। পাশাপাশি পুঁজিবাজার বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে পযাপ্ত পরিমাণে জ্ঞান রাখতে। একই কথা বলছেন পুঁজিবাজার রেগুলেটরাও। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অতি লোভে পড়ে অর্থ হারানোর গর্তে পা দিচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তেমনি মুন্নু এগ্রো এন্ড জেনারেল মেশিনারির শেয়ার দর বৃদ্ধির প্রসঙ্গে ওইসব হাউজের কর্মকর্তারা বলছেন, এই শেয়ারটির ক্রয়—বিক্রয়ের ব্যাপারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আরও সচেতন হতে হবে। কারণ গত দুই মাসে শেয়ারটির দর বেড়েছে ৩০০ টাকা। এটা কোনো স্বাভাবিক বৃদ্ধি মধ্যে পড়ে না।
মুন্নু এগ্রো এন্ড জেনারেল মেশিনারির শেয়ারটির দর আকাশচুম্বী হয়ে পড়েছে। কারণবিহীন লাফিয়ে লাফিয়ে শেয়ারটির দর গত দুই মাসে বেড়েছে ৩০০ দশমিক ৮০ টাকা। এ ধরনের বৃদ্ধি মাধ্যমে শেয়ারটির বাজারমূল্য বেড়েছে ৮২ কোটি ১৯ লাখ ৫ হাজার ৯২০ টাকা। শেয়ার দরের এ বৃদ্ধি নিয়ে কোম্পানির শেয়ার ধারন করা বিনিয়োগকারীদের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। যা এই কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ ক্ষেত্রে সুখবর নয়। অপরদিক এ কোম্পানির শেয়ার দর কেন এতো বাড়ছে, তার প্রকৃত কারণ জানে না ধারন করা বিনিয়োগকারীরা।
শেয়ার দর বৃদ্ধির প্রসঙ্গে মুন্নু এগ্রো এন্ড জেনারেল মেশিনারির সচিব বিনয় পালকে মুঠোফোনে বলেন, শেয়ার দর বাড়ার মতো কোনো মূল্য সংবেদনশীন তথ্য নেই। যা ছিল তা ডিএসইকে জানিয়েছি। এর বাইরে বলার কিছু নেই। অপরদিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক কর্মকর্তা বলেন, শেয়ার দর বৃদ্ধি কারণ জানতে ডিএসই গত ১২ ডিসেম্বর মুন্নু এগ্রো এন্ড জেনারেল মেশিনারিকে চিঠি পাঠিয়েছি। চিঠির জবাব ছিল শেয়ার দর বাড়ার মতো কোনো মূল্য সংবেদনশীন তথ্য নেই। এরপরও শেয়ারটির দর নিয়ে কাজ করছি। দর বাড়ার কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অতি দরের ব্যাপারে প্রয়োজনে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো।
শেয়ার দর বৃদ্ধির একই বিযয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, পুঁজিবাজারের কোনো কোম্পানির শেয়ার দর বাড়লো বা কমলো, সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়। আমরা দেখি শেয়ার দর বাড়া বা কমার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা। সেই হিসেবে মুন্নু এগ্রো এন্ড জেনারেল মেশিনারির শেয়ার দর বৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। এটা নিয়ে কাজ হচ্ছে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, গত দুই মাসে মুন্নু এগ্রো এন্ড জেনারেল মেশিনারির শেয়ার দর ৩০০ টাকা থেকে বেড়ে আটশ টাকায় ওপরে চলে এসেছে। কোনো কারণ বা কোনো পরিকল্পনায় শেয়ার দর এভাবে বেড়েছে তার কারণ জানা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। নিয়ম অনুসারে কোম্পানির কর্মকর্তারা শেয়ার দর বাড়া-কমার পেছনে কাজ করে না জানিয়ে তারা বলছেন, এটা আমরা জানি। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোম্পানির শেয়ার দর বাড়া—কমায় তাদের (কর্মকর্তা) অদৃশ্য ছোঁয়া থাকে। তাদের ছোঁয়া ছাড়া কোনো কোম্পানির শেয়ার দর লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যায় না। কারণ তারাই জানেন কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য। যেসব তথ্য শেয়ার বাড়া-কমার ক্ষেত্রে জাদুকরি ভূমিকা রাখে। তাই শেয়ার দর বাড়ার জাদুকরি এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে পুঁজিবাজার রেগুরেটরকে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত বৃহস্পতিবার মুন্নু এগ্রো এন্ড জেনারেল মেশিনারির শেয়ার দর দাঁড়ায় ৮০৩ দশমিক ৮০ টাকা। এর আগে ৯ নভেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ৫০৯ টাকা। দুই মাসে কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৩০০ দশমিক ৮০ টাকা। কোম্পানিটির শেয়ার সংখ্যা ২৭ লাখ ৩২ হাজার ৪০০টি। সেই হিসাবে গত বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির মোট শেয়ারের বাজার মূল্যে হয়েছে ২১৯ কোটি ৬৩ লাখ ৩ হাজার ১২০ টাকা। গত ৯ নভেম্বর শেয়ারের বাজার মূল্যে ছিল ১৩৯ কোটি ৭ লাখ ৯১ হাজার ৬০০ টাকা। এই সময়ের ব্যবধানে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের বাজার মূল্যে বেড়েছে ৮২ কোটি ১৯ লাখ ৫ হাজার ৯২০ টাকা।
মুন্নু এগ্রো এন্ড জেনারেল মেশিনারির মোট শেয়ারের মধ্যে ৫৪ দশমিক ১৬ শতাংশ ধারন করেছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ ধারন করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ ধারন করেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। সেই হিসেবে বিদেশি, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারে বাজার মূল্যে বেড়েছে ৫২ কোটি ৮৮ লাখ ১৪ হাজার ২৬৮ টাকা। এধরনের বৃদ্ধি কোনো মতে মানতে রাজি নন বিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা। তাই শেয়ার দর বাড়ার কারণ জানার জন্য সংশ্লিষ্ট রেগুলেটরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে কোনো কোম্পানির মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) ১৫ পয়েন্ট ছাড়ালেই তা বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) মার্জিন ঋণের যোগ্যতা হিসেবে সর্বোচ্চ ৪০ পিই রেশিও বেঁধে দিয়েছে। এ হিসেবে ৪০ পর্যন্ত পিইধারীর শেয়ার বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ বলে জানান বিএসইসি। গত বৃহস্পতিবার মুন্নু এগ্রো এন্ড জেনারেল মেশিনারির অডিটেড রিপোর্টে পিই রেশিও দাঁড়ায় ৫০৫ দশমিক ৫৩ পয়েন্ট। আন-অডিটেড রিপোর্টে পিই রেশিও দাড়ায় ২৯৯ দশমিক ৯৩ পয়েন্ট। মানে পিই রেশিও হিসাবে, বিনিয়োগ নিরাপদ অবস্থানে নেই। বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ।
ডিএসইর সূত্র মতে, মুন্নু এগ্রো এন্ড জেনারেল মেশিনারি প্রথম কোয়াটারে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ২০২২ সাল) শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে দশমিক ৬৭ টাকা। শেয়ার প্রতি সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়ায় ১৭৪ দশমিক ৬৪ টাকা। নগদ প্রবাহ ১ দশমিক ৬১ টাকা। জুন ২০২২ সাল হিসেবে, কোম্পানিটির স্বল্পমেয়াদে ৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকার লোন রয়েছে। বর্তমানে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ২ কোটি ৭৩ লাখ ২০ টাকা। রিজার্ভ ৪৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। শেয়ার সংখ্যা ২৭ লাখ ৩২ হাজার ৪০০টি। কোম্পানিটি মোট শেয়ারের ৩৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালক একাই ধারন করেছে। ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ছিলো মুন্নু এগ্রো এন্ড জেনারেল মেশিনারি।
আনন্দবাজার/শহক