ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তেলে ফের ধস

তেলে ফের ধস

বিশ্ববাজারে ফের ধস নেমেছে জ্বালানি তেলের দামে। দুই ধরনের অপরিশোধিত তেলের দামই কমেছে। তথ্য বলছে, প্রায় ৩ শতাংশ কমে ৮০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে দাম। গত শুক্রবার প্রতি ব্যারেল ডব্লিউটিআই অপরিশোধিত তেলের দর ২ শতাংশ বা আড়াই ডলার কমে ৭৫ ডলারের নিচে ৭৪ ডলার ২৪ সেন্টে নেমেছে। আর ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম ৮০ ডলারের নিচে ৭৮ ডলার ৯৪ সেন্টে নেমেছে। এই দর গত এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর এত নিচে তেলের দাম নামেনি বলে তথ্য দিয়েছে সংস্থাটি। গত বছরের ২২ ডিসেম্বর ইউএস ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ৭৫ ডলার ৬০ সেন্ট। আর ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ৮০ ডলার ৯৬ সেন্ট।

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ আবারও নীতিনির্ধারণী সুদের হার অরেক দফা বাড়িয়েছে। আরও বাড়ানোর পূর্বাভাস দিয়েছে। আর এতে শুক্রবার জ্বালানি তেলের দামে পতন হয়েছে বলে মনে করছে রয়র্টার্স। বুধবার সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, দ্রব্যমূল্য যেভাবে দ্রুতগতিতে বাড়ছে, তাতে এর লাগাম টানতে সুদের হার আরও বাড়াতে হতে পারে। এবারে নীতি সুদের হার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানোর ব্যাপারে নীতিনির্ধারকরা ঐকমত্য হন। তবে তা পরিমাণে তাদের সাম্প্রতিক ঘোষণাগুলোর তুলনায় কম। এর ফলে ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, সেদিকেই এগোচ্ছে। এটিই গত ১৫ বছরের মধ্যে দেশটিতে নীতি সুদের সর্বোচ্চ হার।

ফেডারেল রিজার্ভের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ব্যাংক খাতের প্রধান সুদহার এখন যে অবস্থায় আছে, তা থেকে আগামী এক বছরে ৫ শতাংশ বেশি হতে পারে। তবে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা অধিকতর সতর্কতার সঙ্গে এগোতে শুরু করেছেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এখন কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক মূল্যস্ফীতির প্রকোপের মধ্যে রয়েছে। জ্বালানি তেলের এই দরপতনকে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য সুখবর বলছেন জ্বালানি বিশ্লেষকরা। নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, মন্দার আশঙ্কার মধ্যে এই সুখবর এসেছে। যে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য বিশ্ব অর্থনীতিতে ওলোটপালট করে দিচ্ছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে সেই তেলের বড় দরপতনে স্বস্তির আভাস পাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

দুই সপ্তাহ ধরে টানা কমে নেমে নভেম্বরের শেষে প্রতি ব্যারেল ডব্লিউটিআই অপরিশোধিত তেল ৭৫ ডলারে নেমে এসেছিল। ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম নেমেছিল ৮১ ডলারে। চলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে অবশ্য কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়েছিল। গত কয় দিনে তা ফের নিম্নমুখী হয়েছে। মূলত বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কায় জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী হয়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের বিভিন্ন শহরে এখনো লকডাউন চলছে। কোথাও কোথাও লকডাউনবিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে। সে কারণে দেশটিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থিমিত হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা বলছে চীনে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবার বেশ খানিকটা কমবে। অন্যদিকে আমেরিকান মুদ্রা ডলার দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। ক্রমবর্ধমান সুদের হার বড় অর্থনীতিকে মন্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ আশঙ্কায় তেলের দাম কমছে বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় বড় দেশ ঋণের সুদের হার বাড়িয়েই চলেছে। অন্য বড় অর্থনীতির দেশগুলোও সেই একই পথ অনুসরণ করছে। আর এটিই বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। ডলার প্রাইস ইনডেক্সের তথ্যানুসারে, চলতি বছর ডলারের দর ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ডলারের দর বাড়লে আমদানি মূল্য বেড়ে যায়, যা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে। সে জন্য ডলারের দর বাড়লে উন্নয়নশীল দেশগুলো জ্বালানি তেল আমদানি হ্রাস করে, বাংলাদেশও যা করেছে। ডলার বাঁচাতে দেশে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে।

বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম গড়ে প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের কাছাকাছি ওঠানামা করছিল, ঠিক তখন বাংলাদেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম একলাফে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। গত ৫ আগস্ট বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়, ডিজেল ও কেরোসিনের প্রতি লিটারের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রল ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা আর অকটেন ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই দিন মধ্যরাত থেকে নতুন দর কার্যকর করা হয়। এর পর থেকেই বাস, ট্রাক, অ্যাপের প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, লঞ্চ ও হিউম্যান হলারের ভাড়া বেড়ে যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আগে থেকেই বাড়তি ছিল, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে তা আরও একদফা বাড়ে।

মন্ত্রীরা বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশেও জ্বালানি তেলের দাম কমানো হবে। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কিছুটা কমলে দেশের বাজারে লিটারে মাত্র পাঁচ টাকা কমানো হয়। মন্দাভাবের কারণে বিশ্ববাজারে দাম কমার ধারা কত দিন অব্যাহত থাকবে, তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ আছে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, দাম কমতে থাকলে ওপেক তেল উত্তোলন আরও হ্রাস করবে। এতে দাম খুব একটা না-ও কমতে পারে।

২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। করোনা মহামারির মধ্যেও টানা বেড়েছে তেলের দাম। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় তা আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়। গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে দুই ধরনের তেলের দামই ৮০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। সে সময় বাংলাদেশ সরকারও ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে নতুন দর ৮০ টাকা নির্ধারণ করে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করলে লাফিয়ে বাড়তে থাকে তেলের দাম। একপর্যায়ে প্রতি ব্যারেল ১৩৯ ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। এরপর থেকে বিভিন্ন উদ্যোগে ওঠানামার মধ্যেই তেলের দর ১১০ থেকে ১১৫ ডলারের মধ্যে ছিল। গত মে মাসের শেষের দিকে তেলের দাম বেড়ে ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।

২০২০ সালের করোনা মহামারির শুরুতে সারা বিশ্বে যখন লকডাউন চলছিল, তখন জ্বালানি তেলের দাম মাইনাস ৩৭ ডলারে নেমে এসেছিল। অর্থাৎ এক ব্যারেল তেল কিনলে ক্রেতাকে উল্টো ৩৭ ডলার দেয়া হয়েছে। এরপর ওপেক ও রাশিয়া ধারাবাহিকভাবে তেল সরবরাহ কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি করে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে গড়ে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৪২ ডলার। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ছিল ৪৯ ডলার। এরপর থেকে গড়ে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ফেব্রুয়ারিতে ৫৩ ডলার, মার্চে ৬০, এপ্রিলে ৬৫, মে-তে ৬৪, জুনে ৬৬, জুলাইয়ে ৭৩ এবং আগস্টে ৭৪ ডলার। অক্টোবরে এই দাম ৮৫ ডলারে ওঠে। সে সময়ই দেশের বাজারে তেলের দাম বাড়ানো হয়। এরপর অবশ্য তেলের দাম খানিকটা কমে আসে। যুদ্ধের কারণে ফের তা বাড়তে থাকে। ইউক্রেনে রুশ হামলার সঙ্গে সঙ্গে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন