দেশে ডলার সংকটের মধ্যে গত মে মাসে বিদেশি ফল আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে সরকার। পরের মাস জুলাইতে বন্ধ করে দেয়া হয় পণ্য আমদানিতে ব্যাংকের ঋণসুবিধা। এর মধ্য দিয়ে ফল আমদানি কমে আসবে বলেই মনে করা হচ্ছিল। তবে সেই মনে করাটা আর বাস্তবে হয়নি। ফল আমদানি তো কমেইনি, বরং ঘটেছে উল্টোটা।
হিসাব মতে, চলতি অর্থবছরের পঞ্চম মাস নভেম্বরে প্রথম মাস জুলাইয়ের চেয়ে বিভিন্ন ধরনের ফল আমদানি ৬১ হাজার ৫৪০ টন বেশি হয়েছে। শতকরা হিসাবে যা ২২০ শতাংশ বেশি। গত জুলাইয়ে ফল আমদানি হয়েছিল ২৭ হাজার ৯৪৫ টন। নভেম্বরে তা প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেড়ে ৮৯ হাজার ৪৮৪ টনে উঠেছে। নভেম্বর মাস শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগে তথ্য সংগ্রহ করায় পুরো মাসের আমদানির হিসাব পাওয়া যায়নি। পুরো মাসের হিসাব করলে ব্যবধানটা আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ‘ফ্রেশ ফ্রুটস’ ও ‘ড্রাই ফ্রুটস’- এই দুই ক্যাটাগরিতে দেশে সব ধরনের ফল আমদানি করা হয়। ড্রাই ফ্রুটস ক্যাটাগরিতে খেজুর, কিশমিশ ও বাদাম আমদানি করা হয়। ফ্রেশ ফ্রুটস ক্যাটাগরিতে রয়েছে আপেল, কমলা, নাশপাতি, আঙুর, মাল্টা, মান্দারিন, আনার, ড্রাই চেরি, ড্রাগন, স্ট্রবেরিসহ ৫২ রকমের ফল। এসব ফল আমদানি হয় দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, নিউজিল্যান্ড, মিসর, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, ভারত, থাইল্যান্ড, তিউনিশিয়া, পোল্যান্ড ও ব্রাজিল থেকে।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, চাহিদার ৪০ শতাংশের মতো ফল দেশেই উৎপাদন হয়, বাকিটা আমদানি করতে হয়। তবে এর মধ্যেই সব ধরনের ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছ ব্যাংকের ঋণসুবিধা।
তবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার ফলাফল উল্টো হয়ে গেছে। সুস্বাদু ও পুষ্টিকর আপেল, আঙুর, কমলা, মাল্টাসহ কোনো ফলের আমদানিই কমেনি। বরং প্রতি মাসে আগের মাসের তুলনায় তা বেড়ে চলেছে। আমদানিকারদের ভাষ্য, আমদানি করা এসব ফলের উৎপাদন দেশে নেই বললেই চলে। এ কারণে এসব ফলের প্রায় সবটাই আমদানি করে চাহিদা পূরণ করা হয়। সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়ে থাকে আপেল, কমলা, আঙুর ও মাল্টা।
তথ্যমতে, গত জুলাই মাসে ফল আমদানি হয় ২৭ হাজার ৯৪৫ টন। আগস্টে ৭ হাজার ৫৩৯ টন বেড়ে ফল আমদানি হয় ৩৫ হাজার ৪৮৫ টন। আগস্টের তুলনায় ১০ হাজার ৩০৬ টন আমদানি বৃদ্ধি পায় সেপ্টেম্বরে। আমদানি হয় ৪৫ হাজার ৭৯১ টন ফল। অক্টোবরে আমদানি দাঁড়ায় ৫৩ হাজার ৬৮১ টনে, যা আগের মাসের তুলনায় ৭ হাজার ৮৯১ টন বেশি। নভেম্বরে আমদানি হয়েছে ৮৯ হাজার ৪৮৪ টন, যা আগের মাসের তুলনায় ৩৫ হাজার ৮০৩ টন, যা প্রায় ৬৭ শতাংশ বেশি।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের চেয়ে সদ্য শেষ হওয়া নভেম্বর মাসে ২২০ শতাংশের বেশি ফল আমদানি হয়েছে। অর্থাৎ জুলাই মাসের চেয়ে নভেম্বরে ফল আমদানি বেড়েছে ৬১ হাজার ৫৩৪ টন। তবে গত বছরের তুলনায় এই সময়ে ফল আমদানি কমেছে ১৭ শতাংশের বেশি। গত বছর জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ফল আমদানি হয় ৩ লাখ ৪ হাজার ৯১৭ দশমিক ২২ টন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর দেশে বিপুল পরিমাণ ফল আমদানির পেছনে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা ব্যয় হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে। এই চাপ সামাল দিতে ব্যয় সংকোচনের জন্য নানা পদক্ষেপ নেয় সরকার। সেই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে আমদানি ব্যয় কমাতে নেয়া হয় বিভিন্ন পদক্ষেপ। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ যাতে আরও কমে না যায়, সে জন্য নেয়া হয় এ সব পদক্ষেপ।
আমদানিকারকরা বলছেন, আগের বছর বাজারে যে পরিমাণ আমদানি হতো, তার চেয়ে কম হচ্ছে। এইটা পাইকারি বাজারে গেলেই বোঝা যায়। আগের যেখানে ১০ ট্রাক মাল নামতে দেখা যেত, সেখানে ৭ ট্রাক দেখা যায়। ফল খাওয়া বিলাসিতা নয়। এটা মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজন। এ জন্য মানুষ এটাকে আর বাড়তি খরচ মনে করে না। এ জন্য ফলের চাহিদা রয়েছে। শুল্কারোপ ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে খরচ বেড়েছে ফল আমদানিতে, যার কারণে প্রতিটি ফলের দামই বেড়েছে। আগের বছরের তুলনায় বিক্রি কিছুটা কম, আমদানিও কম। তবে ক্রেতা এখনও আছে। আমদানি খরচ বৃদ্ধির প্রভাবে ফলের দাম বেড়েছে। খুচরা বাজারে ফল কেজিতে বেড়েছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত।
আনন্দবাজার/শহক