ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চামড়াখাতে বড় স্বপ্ন

চামড়াখাতে বড় স্বপ্ন

পোশাক শিল্পের পরই দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ চামড়ার স্থান। আশির দশক থেকেই এই শিল্পের নানা সমস্যার কথা বলা হলেও একে একটি সুষ্ঠু কাঠামোর মধ্যে আনা যায়নি। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে বার্ষিক রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার চেষ্টা করছে সরকার। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, চামড়াশিল্পে রপ্তানির সম্ভাবনাকে ধরে রাখতে হলে আমদানিযোগ্য কাঁচামাল, শুল্ক ব্যবস্থাপনা, পণ্য ছাড় করা ও ব্যবসা সহজীকরণ নিশ্চিত করা উচিত।

চামড়ার ওপর ভর করে দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় ৯ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে গড়ে উঠেছে প্রায় ২৩০টির ও বেশি ট্যানারি। লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি) সূত্রে জানা যায়, বিশ্বে জুতার মোট বাজারের ৫৫ শতাংশ চীনের দখলে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের এ খাতে অবদান মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ। বর্তমানে প্রায় ৯০টি দেশে বাংলাদেশের জুতা রফতানি হচ্ছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর দেশে প্রায় ৯৯ লাখ পশু কোরবানি হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম কম। কোরবানির সময় পানির চেয়েও কম দামে চামড়া বিক্রি হয়। আবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করার কারণে ও উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় অতীতে চামড়া নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে, মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে।

এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, লেদার পণ্যের মান ঠিক রাখা রপ্তানি বাজারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কাঁচামাল এবং দক্ষ জনশক্তি রয়েছে। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করে আমরা লেদার শিল্পকে অনেকদুর এগিয়ে নিতে পারি। আন্তর্জাতিক বাজারে লেদার পণ্যের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভিয়েতনাম ও চীনের মতো দেশগুলো থেকে লেদার শিল্প স্থানান্তর করা হচ্ছে, যেটি বাংলাদেশে জন্য বড় সুযোগ। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। উন্নতমানের পণ্য উৎপাদন করে লেদার শিল্পকে এগিয়ে নিতে হবে। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের শিল্প উন্নয়নে সহায়তা দিচ্ছে। সরকারও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করছে।

তথ্য বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানির ছিল ১২৩ কোটি ডলারেরও বেশি। ২০১৭-১৮ তে তা ১০৮ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০২ কোটি ডলারে নেমে আসে। কোভিডের কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই খাতের রফতানি কাঙ্খিত মানের হয়নি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রফতানি হয়েছিল ৭৮ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াবিহীন জুতা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রফতানি হয় ৮০ দশমিক ৯৬ কোটি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৭ দশমিক ৯৩ কোটি ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭৫ দশমিক ০৫ কোটি ডলারের জুতা রফতানি হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, তবে এ খাত ঘুরে দাঁড়ানোর এখনো অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে জুতার বাজারেও চামড়াশিল্পের বিরাট অবদান রয়েছে। চামড়া ও চামড়াবিহীন প্রধানত দুই ধরনের জুতা তৈরি হয় দেশে। এতে আমাদের স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে কিছু পণ্য বিদেশেও রফতানি হয়।

লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, কোভিড-পরবর্তী সময়ে নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমাদের এগোতে হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের নীতি সহায়তা প্রয়োজন। সহায়তা পেলে এই খাত আরও এগিয়ে যাবে। আমরা সস্তা নয়, শ্রেষ্ঠ পণ্য রপ্তানি করতে চাই। এখন পণ্যের বহুমুখীকরণ জরুরি।

এ প্রসঙ্গে টিপু মুনশি বলেন, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি গ্রাজুয়েশন করে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। তখন বাংলাদেশের জন্য এলডিসিভুক্ত দেশের সুযোগ-সুবিধা থাকবে না। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করেই দেশকে এগিয়ে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১০০টি ইকোনমিক জোন গড়ে তোলা হচ্ছে। অনেকগুলোর কাজ এখন শেষ পর্যায়ে এগুলোতে অতি সহজেই লেদার শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। ইতোমধ্যে অনেক দেশ বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে এসেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আরও প্রয়োজন। বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগ করলে লাভবান হবেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববাজারের ক্রেতারা এখন বহুমুখী উৎস থেকে চামড়া সংগ্রহ করছেন। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। এ জন্য চামড়াশিল্পকে আরো প্রতিযোগিতার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। বিশেষ করে সাভারের শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারকে আরো বেশি কার্যকর করতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্পনগরী হিসেবে এর উত্তরণ ঘটাতে হবে। এ শিল্পের রফতানি বাড়াতে হলে পরিবেশসম্মত ট্যানারি স্থাপনের বিকল্প নেই। রফতানিকে আরো গতিশীল করার জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ পাওয়ার জন্য এবং পরিবেশবান্ধব বর্জ্য শোধনাগার ও তার বর্জ্য ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।

চামড়াখাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববাজারে স্থান করে নিতেই নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে গত ৭ ডিসেম্বর থেকে রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেশন সিটি বসুন্ধরায় চলছে চামড়া শিল্পের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী ‘লেদারটেক বাংলাদেশ ২০২২’র অষ্টম আসর। তিনদিনের এই প্রদর্শনীটি শেষ হচ্ছে আজ ৯ ডিসেম্বর।

তিনদিনব্যাপী এ ট্রেড শো’তে বাংলাদেশের চামড়া, চামড়াজাত পণ্য এবং ফুটওয়্যার শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় মেশিনারি, কম্পোনেন্ট, ক্যামিকেল এবং অ্যাকসেসরিজ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় প্রযুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে। ভারত থেকে কাউন্সিল ফর লেদার এক্সপোর্টস (সিএলই) এবং ইন্ডিয়ান ফুটওযয়্যার কম্পোনেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (ইফকোমা) প্যাভিলিয়ন সহ ১০টি দেশের প্রায় ২০০ প্রতিষ্ঠান এই আয়োজনের অংশগ্রহণ করেছে।

কোভিড-১৯-এর পরিবর্তিত ব্যবসায়িক ল্যান্ডস্কেপে, ২০২০ সালে চামড়াজাত পণ্যের বিশ্বব্যাপী বাজার অনুমান করা হয়েছিল ২৪০ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এবং ২০২৭ সাল নাগাদ ৩১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সংশোধিত আকারে পৌঁছবে বলে অনুমান করা হচ্ছে, যা ৪ দশমকি ১ শতাংশ এর সিএজিআর এ বৃদ্ধি পাবে। পাদুকা ৪ দশমিক ৮ শতাংশ সিএজিআর রেকর্ড করবে এবং ২০২৭ সালের শেষ নাগাদ মার্কিন ডলার ১১৬ দশমিক ১ বিলিয়নে পৌঁছবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতের জন্য যন্ত্রপাতি এবং আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্রের জন্য জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রদর্শনী হলো লেদারটেক বাংলাদেশ। এবারের মেলায় বাংলাদেশসহ অন্তত ১০টি দেশের প্রায় ২০০টি কোম্পানি তাদের পণ্য প্রদর্শন করছে। আজ শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এই মেলা।

পাদুকা শিল্পকে ‘জাতীয় শিল্প’ হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। এজন্য আলাদা শিল্পনগরী স্থাপন করারও দাবি তোলা হয়েছে। করোনা মহামারির সময়ে কর্মহীন হয়ে পড়তে হয় অনেক শিল্পে জড়িতদের। তারা সে সময় পাদুকা শিল্পের বিকাশে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা ও অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি তোলেন। একই সঙ্গে চামড়াকে জাতীয় সম্পদ হিসাবে গণ্য করে চামড়ার উপযুক্ত মূল্য, সংরক্ষণ, চামড়াজাত বহুমুখী পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করার জোর দাবি জানান।

একই সঙ্গে তারা বিদেশি জুতা আমদানি বন্ধ করতে বলেন। তাছাড়া জুতা তৈরির কাঁচামাল ও পণ্যের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার, জুতা রপ্তানির ক্ষেত্রে উৎপাদকদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান, ছোট উদ্যোক্তাদের সুবিধা নিশ্চিত করার দাবিও তারা জানান। তবে গত এক বছরে সেসব দাবি তেমন পূরণ হয়নি।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন