- বন্ধ হচ্ছে প্রান্তিক মুরগি খামার
- খুলনায় ৪০০ খামার বন্ধ, সহস্রাধিক অনিয়মিত, আত্মকর্মসংস্থানে ভাটা
- সুদমুক্ত ঋণ-উৎপাদন খরচের সঙ্গে সমন্বয় করে বাজার মূল্য নির্ধারণের দাবি
- এক বছরের ব্যবধানে বস্তা প্রতি খাদ্যের দাম বেড়েছে দেড় হাজার টাকা, বাচ্চার মূল্য বৃদ্ধি
খাদ্য, বাচ্চা, ভ্যাকসিনসহ ওষুধের দাম বৃদ্ধি, পুঁজিসংকট, করোনার ধাক্কাসহ নানাবিধ কারণে খুলনার ক্ষুদ্র ও মাঝারী মুরগির খামারিরা আগ্রহ হারাচ্ছে। লোকসানে পুঁজি হারিয়ে অনেকেই বন্ধ করে দিয়েছে খামার।
এদিকে, অধিকাংশ উপজেলা পর্যায়ের অফিসগুলোতে বন্ধ হয়ে যাওয়া খামারিদের কোনো তালিকা নেই। বিগত দু’বছরে উপজেলা পর্যায়ে মুরগি পালনের ওপর কোথাও কোন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। এমনকি রোগ নিয়ন্ত্রণ, বাজারজাতকরণ, উদ্বুদ্ধকরণ তথা খামারিদের উন্নয়নে নেই কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ। তবে কয়েকটি উপজেলায় উঠান বৈঠকের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
কয়রার পশ্চিম দেয়াড়া গ্রামের ব্রয়লার মুরগীর খামারি আজমল হোসেন বলেন, এক বছরের ব্যবধানে ২ হাজার ১শ’ টাকার খাদ্র এখন ৩৬০০ টাকা। একমাস শ্রম দেওয়ার পরেও পারিশ্রমিক উঠছে না। খাবার ও বাচ্চার দাম বাড়লেও মুরগী বিক্রিতে দাম পাচ্ছিনা। তিনি জানান, সম্প্রতি চারশ’ ব্রয়লারের বাচ্চা তোলার পরে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে গিয়ে ভ্যাকসিন কিনতে গেলে জানানো হয় ডিসেম্বরের আগে কোনো ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে না। এরআগেও একবার ৬০০ বাচ্চার জন্য রাণীক্ষেত ও গাম্বুরার ভ্যাকসিন কিনতে গেলে সংকট দেখিয়ে দেয়া হয়নি তাকে।
একই গ্রামের মিলন বলেন, গত মাসে একশ পিস ব্রয়লার মুরগীর বাচ্চা উঠাই। পাইকারি মূল্য আরও কমে যাওয়ায় মাইকিং করে ১৩০ টাকা দরে মঙ্গলবারে ২২ নভেম্বর বিক্রি করে দিয়েছি। নিজেরা পরিশ্রম করি, শ্রমিক খরচ লাগে না। তারপরেও মূলধন তুলতে হিমসিম খাচ্ছি।
মরিয়াম নামে এক বিধবা জানান, পুঁজির সংকটে একশ পিস করে ব্রয়লারের বাচ্চা পালন করি। আগে ভালো লাভ থাকলেও এখন তেমন কিছু থাকেনা।
বটিয়াঘাটা উপজেলার লেয়ার মুরগী খামারী মিজুনুর রহমান জানান, ব্যক্তি উদ্যোগে খামার করি। এক হাজার লেয়ার মুরগী পালন করি। এক চালানে ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করেছি। তবে এখন খাবার ও বাচ্চার দাম বেশি হওয়ায় তেমন লাভ হচ্ছে না।
ডুমুরিয়ার সুবাস চন্দ্র বসু ৭ বছর ব্রয়লারের খামার করেছেন। সর্বশেষ গেল বছর সাড়ে ৩ হাজার ব্রয়লার মুরগী তোলেন। হঠাৎ মুরগীর দাম কমে যাওয়ায় বড় ধরণের ক্ষতিগ্রস্ত হন তিনি। এখন তার খামার বন্ধ। তিনি বলেন, করোনার শুরু থেকে এক চালানে কিছু লাভ হলে অন্য চালানে লোকসান হয়।
খুলনা নগরীর নিরালা এলাকার জিসান নেওয়াজ। লেয়ার মুরগী পালন করতেন তিনি। দীর্ঘ সময় এ পেশার সাথে জড়িত। সর্বশেষ গেল বছর ২২০০ লেয়ার পালন করে লোকসানের স্বীকার হন। তবে পূঁজিঁ পেলে ফের খামার চালু করবেন বলে জানান তিনি।
ওপরের কেউই স্বল্পসুদে ব্যাংক লোন পাননি। তাদের কেউই উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে কোন প্রশিক্ষণ পাননি। এছাড়া নূন্যতম কোনো ধরণের সরকারি সহায়তাও মেলেনি তাদের। সুদমুক্ত ঋণ ও উৎপাদন খরচের সঙ্গে সমন্বয়করে বাজার মূল্য নির্ধারণের দাবি তাদের।
রূপসা, কয়রা, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়ার, পাইকগাছা দিঘলিয়ার প্রায় অর্ধশত খামারিদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি দপ্তর থেকে কোনো খোঁজ নেয়া হয়না। নামমাত্র সুদে ব্যাংক থেকে লোন দেয়া হয় এটার বিষয়েও অধিকাংশই জানেন না। কেউ কেউ ব্যাংকে যোগাযোগ করেও নানা জটিলতায় ঋণ পাচ্ছেন না। সমিতি থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে খামার করছেন তারা। উৎপাদন খরচ প্রায় দ্বিগুণ বাড়লেও মুরগীর দাম প্রায় একই রকম থাকায় লাভ পাচ্ছেন না। এতে তারা এ পেশা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। অনেকেই ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। অনেকে স্বল্প পরিসরে বাচ্চা লালন পালন করছেন। কেউ কেউ ৪ থেকে ৫ মাস পরে এক চালান তুলছেন।
জেলা প্রাণি সম্পদ দপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় তালিকাভুক্ত লেয়ার খামার রয়েছে ৯৮৭টি ও ব্রয়লার খামার রয়েছে ১৯২৭টি। আর নিবন্ধনকৃত রয়েছে ৩৭টি লেয়ার ও ৪০টি ব্রয়লার খামার। ইতিমধ্যে তালিকাভুক্ত চার শতাধিক মুরগীর খামার বন্ধ হয়ে গেছে। তবে তালিকাভুক্ত খামারির বাইরেও বহু খামারি ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। আরও জানা যায়, সহস্রাধিক খামারি নিয়মিত বাচ্চা পালন করছেন না। টিকিয়ে রাখতে মাঝেমধ্যে বাচ্চা উঠাচ্ছেন তারা।
কয়রা উপজেলার উপ-সহকারি প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা সুধাংশু কুমার মন্ডল বলেন, ভ্যাকসিনসংকট থাকায় সকলকে দিতে পারিনা। করোনাকালিন সময় থেকে অন্তত ২৫টি খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া কিছু খামারি অনিয়মিত মুরগী পালন করছেন।
কয়রা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. কাজী মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, বিগত দু’বছরে মুরগী পালনের ওপর আমাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত কিছু খামারিকে প্রণোদনা দেয়া ছাড়া খামারিদের উদ্বুদ্ধ করতে কোনো কার্যক্রম চালু নেই, তবে অফিসে আসলে পরমার্শ দেয়া হয়।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রিয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ও খুলনা পোল্ট্রি ফিস ফিড শিল্প মালিক সমিতির মহাসচিব এসএম সোহরাব হোসেন (প্রাণিপ্রেমী) বলেন, এখন প্রতি কেজি ব্রয়লার উৎপাদনে ১৩০ টাকা খরচ হলেও মঙ্গলবার পাইকারি বিক্রি হয়েছে ১১৮টাকা। ক্রমাগত লোকসানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিরা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে পোলট্রি শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। খামারি হারিয়ে গেলে প্রাণিজ আমিষের উৎস কমবে। এছাড়া আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়বে শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার মানুষ।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি সুমন হাওলাদার সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দিন দিন খাবার ও মেডিসিনের দাম দাম বাড়ছে। কর্পোরেট কোম্পানীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে স্বেচ্ছায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে প্রান্তিক খামারিরা। প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারিদের ধ্বংস করে খামার বন্ধ করতে বাধ্য করছে কর্পোরেট কোম্পানীগুলো। পোল্ট্রিখাত এভাবে চলতে থাকলে তা করপোরেট বা ইন্ডাস্ট্রি আকারে গড়ে ওঠা শিল্পের মালিকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। তখন তারা চড়ামূল্যে ডিম ও মাংস বিক্রি করবে।