ইসলামী ব্যাংক ব্যাংলাদেশের লক্ষ্মীপুরের রায়পুর শাখা নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। খোদ ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই রয়েছে কোটি কোটি টাকা তুলে নেয়ার অভিযোগ। অটোমেটেড টেলার মেশিন বা এটিএম বুথে ছেঁড়া-ফাটা টাকা দেয়ার অভিযোগ তো বেশ পুরনো। এমনকি জাল নোট সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে রায়পুর শাখার বিরুদ্ধে। রাত দশটা না বাজতেই বুথ বন্ধ হওয়ার ঘটনাও ঘটে। যে দুয়েকটি বুথ খোলা থাকে সপ্তাহ ধরে টাকাই থাকে না। তবে সব ছাপিয়ে এবার গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে বুথের কেয়ারটেকারের বিরুদ্ধে।
এমনিতেই দেশে বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। ব্যাংকগুলোর নানা অনিয়মে বাড়ছে ঋণ খেলাপি। হরহামেশাই দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে বিপুল অংকের টাকা। কোনো কোনো ব্যাংকের ভল্টে মিলছে জাল নোট। সব মিলিয়ে ব্যাংকখাত নিয়ে আতংক তৈরি হয়েছে গ্রাহকদের মাঝে। আমানত তুলে নিতে ব্যাংকে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন গ্রাহকরা। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস জানিয়েছেন, আতঙ্কে ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন গ্রাহকরা। ব্যাংকখাত নিয়ে দেশের মানুষের মাঝে যখন এমন প্রতিক্রিয়া তখনই গ্রাহকের অর্থ একাউন্ট থেকে তুলে নেয়ার অভিযোগ উঠলো বুথের কেয়ারটেকারের বিরুদ্ধে।
চলতি বছরের নভেম্বরের ছয় তারিখ। দিনটি ছিলো বৃহস্পতিবার। আয়েশা আক্তার সুইটি নামের এক গ্রাহক গিয়েছিলেন ইসলামী ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা তুলতে। বুথের অবস্থান ছিলো রায়পুর পৌর ৩নং ওয়ার্ডের ফরিদগঞ্জ সিএনজিস্ট্যান্ডে। আয়েশা আক্তারের সঙ্গে বুথে ঢুকেছিলেন কেয়ারটেকার। ‘আপা, আমার কাছে কার্ড দেন আমি তুলে দিচ্ছি’ বলে তুলে দেন ২২ হাজার টাকা। পরে কার্ড বের করে আয়েশা আক্তারকে দিয়ে দেন।
আয়েশার দাবি তিনি একমাস পর চলতি ডিসেম্বরের ১ তারিখে টাকা তুলতে যান একই বুথে। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারেন এটি তার কার্ড নয়। তারেক নামে জনৈক ব্যক্তির। পরে একাউন্ট চেক করে জানতে পারেন এই একমাসে তার একাউন্ট থেকে তুলে নেয়া হয়েছে ২ লাখ ১৮ হাজার টাকা। তার অভিযোগ সরলতার সুযোগ নিয়েছে বুথের কেয়ারটেকার। সেদিন টাকা তুলে দেয়ার নাম করে পিনকোড নিয়ে নিয়েছে। পরে তাকে নকল কার্ড ধরিয়ে দিয়ে আসলটি তার কাছে রেখে দিয়েছে। তিনি বলেন, এই টাকা কেয়ারটেকারই নিয়েছে। এ বিষয়ে ব্রাঞ্চ ইনচার্জকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেছেন, তদন্ত করে বিস্তারিত জানাবেন।
এ বিষয়ে আয়েশা আক্তারের ভাই রিপন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমার ভাই আয়েশার একাউন্টে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা রেখেছে। সেখান থেকে আমাকে দেয়ার জন্য ২২ হাজার টাকা তুলে আনে সে। একমাস পর আবার টাকা তুলতে গেলে সে জানতে পারে যে কার্ডটি তার নয়, অন্য কারো। পরে একাউন্ট চেক করে জানা যায় এই একমাসে একাউন্ট থেকে তুলে নেয়া হয়েছে ২ লাখ ১৮ হাজার টাকা। আমাদের সন্দেহ এটি বুথের কেয়ারটেকার করেছে। ব্যাংকে অভিযোগ দিয়েছি। অপারেশন ইনচার্জ আমাদের বলেছেন, তদন্ত করে জানাবেন।
এ বিষয়ে রায়পুর ব্রাঞ্চের অপারেশন ইনচার্জ ইমরান হোসেন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমরা অভিযোগটি পেয়েছি। ম্যানেজার সাহেব নিজেই বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন। যদি এ কাজে ব্যাংকের কারো সংশ্লিষ্টতা থাকে তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু ব্যাংকের বাইরের কেউ যদি গ্রাহকের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে টাকা তুলে নেয় তাহলে এতে আমাদের কিছুই করার থাকবে না। তাকে সব ধরণের সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান তিনি।
এর আগে ২০১৭ সালে গ্রাহকের নামে ভুয়া বিনিয়োগ ঋণ দেখিয়ে ব্যাংকের ৮ কোটি ৯৭ লাখ ১ হাজার ২১৯ টাকা আত্মসাত করে রায়পুরে ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ। এ ঘটনায় তাকে আটকও করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক সূত্রমতে, নুর মোহাম্মদ ইসলামী ব্যাংকের রায়পুর শাখার এসবিআইএস সুপাভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তখন ১৮৬ গ্রাহকের নামে ভুয়া বিনিয়োগ ঋণ দেখিয়ে ৮ কোটি ৯৭ লাখ ১ হাজার ২১৯ উত্তোলন করেন। যার পুরোটাই তিনি আত্মাসাৎ করেছেন। ব্যাংকের অডিট টিম বিষয়টির সত্যতা পায়। কোনো গ্রাহক ঋণ গ্রহণ না করলেও তিনি ভুয়া ও জাল ভাউচার তৈরি করে ব্যাংক থেকে ঋণ অনুমোদন করে নিজেই আত্মসাৎ করেছেন। এই মামলায় এখনও তিনি কারাগারে আছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রায়পুর শহরের হাজী আলী আকবর সুপার মার্কেটের দেওয়ানজী বস্ত্র বিতানের আবু মহসিন টেলু দেওয়ানজির (সিএ-৮৭৯) ৪৬ লাখ টাকা, হায়দরগঞ্জের মো. মাইনুদ্দিনের সিয়াম এন্টারপ্রাইজের (সিএ-৭২১) ৩৬ লাখ, বোরহান উদ্দিনের আল আমিন এন্টারপ্রাইজের (সিএ-৩৫৮) ৩৭ লাখ, বাসাবাড়ি বাজারের ভুলু পাটওয়ারীর অভি ট্রেডার্সের (সিএ-৯৮৯) ১৯ লাখ ৫০ হাজার, নুর এন্টারপ্রাইজের নামে ১৩ লাখ টাকা, বিল্লাল হোসেনের বিল্লাল স্টোরের ১৭ লাখ, আব্দুল মান্নানের ‘মান্নান ট্রেডার্স’র ৫৯ লাখ ৩৯ হাজারসহ ১৮৬ গ্রাহকের নামে টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এদিকে, ইসলামী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির সংবাদ প্রকাশের পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ব্যাংকটি। চরম আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েন গ্রাহকরা। যার প্রভাব পড়েছে রায়পুর ব্রাঞ্চেও। প্রতিদিন হাজার হাজার আমানতকারী ভিড় জমাচ্ছেন টাকা তুলে নিতে। তাদের চাপে তিল ধারণের ঠাঁই মিলছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুজবের কারণে একাউন্ট থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছেন গ্রাহকরা। আমানত তুলে নেয়া শরিফুল নামের এক ব্যক্তি বলেন, ইসলামী ব্যাংকে আমার ২০ লাখ টাকা জমা ছিলো। ব্যাংকের সব টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। আর কিছু দিন পর হয়তো কোনো টাকাই থাকবে না। তাই আমার একাউন্টে থাকা টাকা আমি তুলে নিয়ে এসেছি। এদিকে আবার চোর ডাকাতের ভয়ও আছে। কি করবো বুঝতে পারছি না।
রায়পুর ব্রাঞ্চের অপারেশন ইনচার্জ ইমরান হোসেন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমানত তুলে নেয়ার জন্য মানুষের এত ভিড় যে খাওয়ার সময়টুকুও আমরা পাচ্ছি না। গুজবের কারণে মানুষ ব্যাংক থেকে তাদের টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এক সপ্তাহ ধরে আমাদের কোনো বিরতি নেই। তিনি জানান, দৈনিক ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা তুলে নিচ্ছেন গ্রাহকরা। এ সপ্তাহে প্রায় একশো কোটি টাকা উত্তোলন করে ফেলেছে।
আনন্দবাজার/শহক