ঢাকা | বৃহস্পতিবার
২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মেটালপণ্যের বাজারে সুবাতাস

মেটালপণ্যের বাজারে সুবাতাস
  • স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি বেড়েছে সাতগুণ
  • ১০৯৫ কোটি টাকার ১৮ স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি

চলতি অর্থবছরের প্রথম তিনমাস টানা অবনতির পর অক্টোবরে সাত গুণ বেড়েছে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি। যে কারণে মেটাল পণ্যের দাম নিয়ে উঠেছে শঙ্কা। আশঙ্কা করা হচ্ছে অধিক হারের এ আমদানিতে শিগগিরই স্ক্র্যাপ মেটালের দাম বেড়ে যাবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, চলতি বছরের অক্টোবরে ১ হাজার ৯৫ কোটি টাকা মূল্যের ১৮টি স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে দেশে; যেখানে সেপ্টেম্বরে আমদানি হয়েছিল ১৪৭ কোটি টাকা মূল্যের মাত্র ৬টি জাহাজ।

আগের মাসগুলোতে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি কমার কারণ হলো, রিজার্ভ কমে আসায় ডলার সাশ্রয়ে গেল জুলাইয়ে পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলার সংকটের এ সময়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতেই এমন উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে এনবিআরের তথ্য দেখায়, চলতি বছরের জুলাইতে ১৭২ কোটি টাকায় ৯টি এবং আগস্টে ৪০৯ কোটি টাকায় ১২টি জাহাজ আমদানি করা হয়েছে।

এছাড়া, চলতি অর্থবছরের (২০২২-২০২৩) গেল চারমাসে ১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকায় আমদানি করা হয়েছে ৪৫টি স্ক্র্যাপ জাহাজ। এরমধ্যে ৭২৮ কোটি টাকার ২৭টি জাহাজ আমদানি হয়েছে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে। জাহাজভাঙা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, শিপ ইয়ার্ড ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক মালিকরাই হঠাৎ স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি বৃদ্ধির পিছনে ভূমিকা রাখছেন।

তারা বলেন, জুলাই মাস থেকে আমদানি কমে যাওয়ায় এই শিল্পে প্রধান কাঁচামাল, স্ক্র্যাপ মেটাল ঘাটতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে; আর এরমধ্যেই একদল ইয়ার্ড মালিক এর সুযোগ নিচ্ছে। তারা অভিযোগ করেন, বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের এই সময়ে সাধারণ ব্যবসায়ীরা যখন স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানির জন্য এলসি খুলতে সমস্যার মুখে পড়ছেন, তখন ব্যাংকার শিপ ইয়ার্ড ব্যাবসায়ীরা এক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় কিছুটা হলেও সুবিধা ভোগ করছেন। 

অক্টোবরে ১ হাজার ৯৫ কোটি টাকার স্ক্র্যপ জাহাজ আমদানি হয়েছে। এরমধ্যে ৬৬০ কোটি টাকার ৮টি জাহাজ আমদানি করেছেন পাঁচজন ব্যবসায়ী, যারা হয় কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান, নয়তো পরিচালক। আর অন্যান্য ব্যবসায়ীরা আমদানি করেছেন বাকি সাড়ে ৪৩৫ কোটি টাকার জাহাজ। এমনটিই দেখা গেছে এনবিআর’র তথ্যে। এই শিপইয়ার্ড মালিকরা জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আরও ৪০৮ কোটি টাকার জাহাজ আমদানি করেছেন। সাধারণ ইয়ার্ড মালিকদের আশঙ্কা, ঘাটতির কারণে শীঘ্রই স্ক্র্যাপ মেটালের দাম বাড়তে চলেছে।

সাধারণ ব্যবসায়ী ও ব্যাংক মালিকদের এই অসম প্রতিযোগিতার বিষয়ে কেআর গ্রুপের চেয়ারম্যান সেকান্দার হোসেন টিংকু বলেন, ডলার সংকটের এই সময়ে সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বেশিরভাগ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের উদ্যোক্তা জাহাজ আমদানি কমিয়ে কিংবা সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছে। যদিও এতে ইয়ার্ড মালিকদের পরিচালন খরচসহ লোকসান গুনতে হচ্ছে।

কিন্তু কিছু কিছু ইয়ার্ড মালিক, বিশেষ করে যাদের ব্যাংকের মালিকানা রয়েছে, তারা প্রভাব খাটিয়ে শত শত কোটি টাকা মূল্যের স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করছে। এই প্রবণতা ডলার সংকটকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এনবিআর’র তথ্যমতে, ব্যাংক মালিকদের মধ্যে গেল চারমাসে সর্বোচ্চ টাকার জাহাজ আমদানি করেছেন আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক লিয়াকত আলী চৌধুরী। তার প্রতিষ্ঠান যমুনা শিপ ব্রেকার্স গেল অক্টোবরে ২৪৭ কোটি টাকার জাহাজ আমদানি করেছে; আর সেপ্টেম্বরে ৬৬ কোটি টাকার একটি জাহাজ আমদানি করে তার প্রতিষ্ঠান। অথচ চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) প্রতিষ্ঠানটি একটি জাহাজও আমদানি করেনি।

অন্যান্য বড় আমদানিকারকদের মধ্যে রয়েছেন ইর্স্টান ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. শওকত আলী চৌধুরী। তার মালিকানাধীন মেসার্স এসএন করপোরেশন গত দুইমাসে ১৩৩ কোটি টাকায় দুইটি জাহাজ আমদানি করেছে। আর এর আগের পাঁচমাসে মাত্র ৯৫ কোটি টাকার তিনটি জাহাজ আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি।

এছাড়া, শওকত আলী চৌধুরীর ভাগিনা, শিপ ইয়ার্ড ব্যবসায়ী কাজী মহরম আলী বাবু গত চারমাসে ১৮০ কোটি টাকায় ৩টি জাহাজ আমদানি করেছেন। একইভাবে, মিডল্যান্ড ব্যাংকের পরিচালক মাস্টার আবুল কাশেম অক্টোবরে ২৫ কোটি টাকার জাহাজ আমদানি করেন। অথচ আগের তিনমাসে ৩১ কোটি টাকার মাত্র ২টি জাহাজ আমদানি করে তার প্রতিষ্ঠান।

মধুমতি ব্যাংকের পরিচালক দিদারুল আলমের পারিবারিক দুটি প্রতিষ্ঠান গেল অক্টোবরে ১৬ কোটি টাকায় ২টি জাহাজ আমদানি করে। অথচ এর আগের তিনমাসে ২৬ কোটি টাকায় তার প্রতিষ্ঠান আমদানি করে মাত্র ৩টি জাহাজ। সংকটের এই সময়ে উচ্চ মূল্যের জাহাজ আমদানির বিষয়ে জানতে চাইলে কথা বলতে রাজি হননি আল আরাফাহ ব্যাংকের পরিচালক লিয়াকত আলী চৌধুরী।

ইর্স্টান ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. শওকত আলী চৌধুরী দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে ডলার সংকটের সময় জাহাজ আমদানি বৃদ্ধির বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হন নি প্রতিষ্ঠানটির (এসএন করপোরেশন) পরিচালক বরকত উল্লাহ।

তবে মিডল্যান্ড ব্যাংকের পরিচালক মাস্টার আবুল কাশেম বলেন, ডেফার্ড এলসির মাধ্যমে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়। যেহেতু আমদানির দায় পরিশোধে ছয় মাস সময় পাওয়া যায়, তাই স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানির ফলে ডলারে খুব দ্রুত প্রভাব পড়বে না।

মধুমতি ব্যাংকের পরিচালক দিদারুল আলমও দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি। তবে জুলাই-আগস্ট মোট আমদানি কমে অক্টোবরে কয়েকগুন বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন দিদারুল আলমের বাবা ও তাহের গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আবু তাহের। তিনি বলেন, তিন-চার মাস আমদানি কমে যাওয়ায় শিপ ব্রেকিং ও ইস্পাত খাতে কাঁচামাল সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়। ইয়ার্ড এবং কারখানা সচল রাখতে এ সময়ে যাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে, তারা আমদানি বাড়িয়েছেন।

ডলার সংকটে বড় অংকের কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, এমনিতেই আমদানি-রপ্তানিতে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশে অর্থ পাচার ঘটে চলেছে। এরমধ্যে রির্জাভ সংকটের এই সময়ে বড় বড় ভলিউমের স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হচ্ছে। এই সময়ে কম প্রয়োজনীয় এসব পণ্য আমদানি সংকট আরো বাড়িয়ে দেবে।

ব্যাংক এশিয়ার এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রামের জোনাল হেড জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ডলার সংকটের কারণে আমরা নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্য ও শতভাগ রপ্তানিমুখী পণ্য আমদানিতেই হিমশিম খাচ্ছি। তাই গত জুলাই থেকে বিলাস পণ্য কিংবা কম প্রয়োজনীয় আমদানির ঋণপত্র খোলা বন্ধ রেখেছি। দেশের এই সংকটময় সময়ে শত শত কোটি টাকার স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি আরও বলেন, বিলাসবহুল এবং কম প্রয়োজনীয় এসব পণ্য আমদানি বন্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আরো কঠোর হওয়া উচিত।

গেল অর্থবছরে (২০২১-২২) ইয়ার্ডগুলোতে মোট ২৩২ টি জাহাজ আমদানি হয়েছে। এসব জাহাজ আমদানিতে খরচ হয়েছে ১৩ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। সেই হিসেবে প্রতিমাসে গড়ে ১ হাজার ১৩২ কোটি টাকার জাহাজ আমদানি হয়েছে। চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলে গড়ে ওঠা শিপ ব্রেকিং খাতে বর্তমানে প্রায় ৩৫ টি ইয়ার্ডে জাহাজ ভাঙার কাজ চলে। যদিও বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইকেলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ১১৫টি প্রতিষ্ঠান।

সংবাদটি শেয়ার করুন