মূল্যস্ফীতি কমলেও বাজারে প্রভাব নেই
সংকট বাড়ছে
- দাম বেড়েছে সয়াবিন-চিনির
- বাড়ার পরেই বাজারে উধাও
- বেশি দামেও মিলছে না পণ্য
সংকটের মধ্যেই দাম বেড়েছে সয়াবিন তেল ও চিনি। তবে দাম বাড়ার পর পরই যেন নিত্যপণ্যের বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে পণ্য দুটি। বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১২ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম কেজিতে বাড়ানো হয়েছে ১৩ টাকা। যা ১৭ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। তবে কার্যকর হওয়া বাড়তি দামেও ক্রেতারা তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য পাচ্ছেন না। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে এমন চিত্র দেখা গেছে। আবার বাজারে সংকটের অজুহাতে খোলা বাজারে নির্ধারিত দাম থেকে ১০ টাকা বেশি এবং পাইকারি বাজারে ৩-৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে তেল-চিনি। তবে শুধু যে তেল চিনির দামই বাড়তি তা নয়, অন্য নিত্যপণ্যের দামও চড়াও। যেন পাল্লা দিচ্ছে তেল চিনের বাজারের সঙ্গে।
তবে নিত্যপণ্যের বাজারের এই চিত্রের সঙ্গে অনেক তথ্য মিলছে না। কেননা, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, টানা দুই মাস ধরে দেশের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে থাকার পর বিদায়ী অক্টোবরে কিছুটা কমেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী অক্টোবর মাস শেষে মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশে। অথচ সেপ্টেম্বরে এ হার ছিল ৯ দশমিক ১০ ও আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসাবে চলতি মাসে মূল্যস্ফীতি কমে গিয়ে বাজারে তার প্রভাব পড়ার কথা। তবে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। নিত্যপণ্য গত বছরের এই সময়ের চেয়ে এখন বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
এমনকি সরকারের বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্যও বলছে, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। তাদের হিসাবে, গত এক বছরে খোলা আটার দাম কেজিতে বেড়েছে ৭৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। এছাড়া ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর প্রতি কেজি প্যাকেট আটার দাম ছিল ৩৮ টাকা। ২০২২ সালের ১৮ নভেম্বর সেই আটা ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ৭০ টাকা কেজি দরে। সরকারের হিসাবেই এই প্যাকেট আটার দাম বেড়েছে কেজিতে ৬৯ শতাংশের বেশি।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী খোলা ময়দার দাম বেড়েছে ৫৩ শতাংশের বেশি। আর প্যাকেট ময়দার দাম কেজিতে বেড়েছে ৫৮ শতাংশের বেশি। শুধু তাই নয়, গত এক বছরে খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে বেড়েছে ২৮ শতাংশের বেশি। বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। মসুর ডালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। এমনকি রসুনের দাম কেজিতে বেড়েছে ৬০ শতাংশের মতো।
যদিও বিবিএসের হিসাবে, গত মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলছেন, বাস্তবে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি, তবে কমিয়ে দেখানো হচ্ছে। সম্প্রতি এক সেমিনারে তিনি বলেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকটে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে স্বল্প আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। তাদের খাদ্যতালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিতে হচ্ছে।
গত বছরের এই সময়ে খোলা আটা বিক্রি হতো ৩৩ টাকা কেজি। এখন সেই আটা ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৬২ টাকা কেজি দরে। রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র। বিক্রেতারা বলছেন, বেশি দামে কিনতে হয় বলেই তো বেশি দামে বিক্রি করা হয়। বাজারে সরবরাহ কমে গেলে দাম নিয়ন্ত্রণ তো আমরা করতে পারি না।
রাজধানীর অনেক বাজারে খোলা সয়াবিন তেল পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ১৮৮-১৯০ টাকায় এবং খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ১৯৫-২০০ টাকায়। অন্যদিকে বোতলজাত সয়াবিন তেল গায়ে থাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে ২ লিটার ৩৫৫ টাকা এবং ৫ লিটার ৮৮০ টাকায় আগের দামে বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতারা বলছেন, নতুন দামের তেল এখনও বাজারে আসেনি। দুয়েকদিনের মধ্যেই নতুন দামের তেল বাজারে পাওয়া যাবে।
বাজারের তথ্য বলছে, গত বছরের এই সময়ে এক কেজি দেশি শুকনো মরিচ কিনতে ক্রেতাদের খরচ হতো ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা। এখন সেই মরিচ কিনতে হচ্ছে ৪০০ টাকা কেজি। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী গত এক বছরে দেশি শুকনো মরিচের দাম কেজিতে বেড়েছে ১২০ শতাংশের মতো। আর আমদানি করা শুকনো মরিচের দাম কেজিতে বেড়েছে ৭২ শতাংশ। গত বছরের এই সময়ে দেশি আদার দাম ছিল ১০০ টাকা কেজি। এখন সেই আদা ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ২২০ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার এই দেশি আদার দাম বেড়েছে ৯১ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে আমদানি পণ্যের দাম বেড়েছে। এরমধ্যে সরকার তেল ও চিনির দাম নতুন করে নির্ধারণ করে দিলেও বাজারে এর চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর মৌসুম শেষে সরবরাহ কমতে থাকায় অব্যাহতভাবে বাড়ছে চালের দাম। যদিও টিসিবির হিসাবে গত এক বছরে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৮ শতাংশের মতো।
গত ১৭ নভেম্বর সরকারিভাবে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১২ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম কেজিতে বাড়ানো হয়েছে ১৩ টাকা। তবে বাড়তি দামেও বাজারে মিলছে না তেল-চিনি। ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে এর চেয়েও বাড়তি দামে।