প্রাকৃতিক দুর্যোগে অস্তিত্ব সংকটে মানবসভ্যতা
ভয়াবহ বিপদ
- ঘূর্ণিঝড়ে বাড়ছে জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব
- তাপদাহের প্রবণতায় বাড়ছে দাবানল
- তীব্র খরায় বিপর্যয়ে কৃষিউৎপাদন
- বাড়ছে ভূমিকম্প- ভূমিধসের মাত্রা
- কমছে আয়ু, বিপদে শিশু-অন্তঃস্বত্ত্বা
- বেশি ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় বাংলাদেশ
আমরা একটা অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছি: জগান চাপাগাইন, ডিজি, রেডক্রস
আগামীতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মারাত্মক আকার ধারণ করবে: মার্টিন গ্রিফিথস, প্রধান, মানবিকবিষয়ক দপ্তর, জাতিসংঘ
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারন করছে। প্রতিনিয়ত নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে গোটা বিশ্ব। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, ভুমিকম্প, তাপদাহ, দাবদাহ এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আর এসব কারণে দেখা দিয়েছে ঋতু বিপর্যয়ের ঘটনা। পৃথিবীর তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। যে কারণে কমে এসেছে শীতকালের সময়; বেড়েছে গ্রীষ্মকালের আয়ুষ্কাল। বিজ্ঞানীরা সতর্কবার্তা দিয়ে বলছেন, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্বের কিছু অঞ্চলে দাবদাহের তীব্রতা এত ভয়ঙ্কর হবে যে সেসব অঞ্চল মানুষের বসবাসের একেবারেই অনুপোযোগী হয়ে উঠবে। বহু জনবহুল এলাকা হয়ে পড়বে বসবাসের অযোগ্য। বাস্তুচ্যুতির মাত্রা বাড়বে বিপদজ্জনকভাবে বাড়বে। সম্প্রতি জাতিসংঘ ও রেডক্রসের নতুন এক প্রতিবেদনে এমন সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবিক বিষয় সমন্বয়কারী দপ্তর (ওসিএইচএ) এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (আইএফআরসি) যৌথভাবে গত ১০ অক্টোবর প্রকাশিত প্রতিবেদনে যেসব দিক উঠে এসেছে তা উদ্বেগজনক। ‘চরম তাপমাত্রা: ভবিষ্যৎ দাবদাহের জন্য প্রস্তুতি’ শিরোনামের যৌথ সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ৩৮টি দাবদাহের ঘটনায় ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চাইতে বেশি হতে পারে।
ওসিএইচএ এবং আইএফআরসি সংস্থা দু’টির দাবি, হর্ন অব আফ্রিকা তথা আফ্রিকার মূল মহাদেশীয় ভূখণ্ডের পূর্বতম অঞ্চল, সাহিল অঞ্চল ও দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ায় তাপপ্রবাহের প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি। সোমালিয়া ও পাকিস্তানের মতো দেশ এখনই তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হচ্ছে, ধারণা করা হচ্ছে ভবিষ্যতে তাদের দুর্ভোগ বাড়বে। পরিবেশের অবক্ষয় ও তাপপ্রবাহের ফলে বৈষম্য থেকে জীবনহানি, আশঙ্কা রয়েছে সব কিছুরই।
প্রতিবেদনে আরও সতর্ক করা হয়েছে, প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দাবদাহের কারণে বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। আগামী দিনগুলোয় প্রাকৃতিক এসব বিপর্যয় আরও ভয়াবহ, ঘন ঘন ও তীব্রতর হবে। ভবিষ্যতে দাবদাহ–সম্পর্কিত মানবিক জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ারই পূর্বাভাস দিচ্ছে এসব বিপর্যয়। এখন থেকেই জোরকদমে পদক্ষেপ না করলে আগামী দিনে পৃথিবীর তাপমাত্রা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছবে যেখানে কোনও ভাবেই আর মানিয়ে নিতে পারবে না মানুষ। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাহিল, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া।
এছাড়া, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত নগরায়ণের ফলে আগামী দশকে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির অসুস্থ ও বয়স্ক মানুষদের আয়ু কমবে অনেকটাই। একই প্রভাব দেখা যাবে শিশু ও অন্তঃস্বত্ত্বা মহিলাদের ক্ষেত্রে।
প্রতিবেদনে দাবি, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে যথাযথ পদক্ষেপ না করলে এই শতকের শেষে ক্যানসার বা সংক্রামক ব্যাধির ফলে মৃত্যুর হারের সঙ্গে পাল্লা দেবে তাপপ্রবাহে মৃত্যুর হার। এসব মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রস্তাব দিয়েছে জাতিসংঘ ও রেড ক্রস। সেগুলির অন্যতম হল, প্রবল গরমে মানুষকে আশ্রয় দিতে তাপনিরোধক জরুরিকালীন আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা।
গত কয়েক মাসের বৈশ্বিক আবহাওয়া বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, থাইল্যান্ডের মতো বহু দেশে ভয়াবহ বন্যার ঘটনা ঘটেছে। পাকিস্তানে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কারণে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হয়েছিল দেশটিকে। বলা হয়েছে, দেশটির এক তৃতীয়াংশ ডুবে গেছে পানিতে। গত জুনের মাঝামাঝি থেকে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে দেশটিতে ভূমিধস আর বন্যা দেখা দেয়। সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কমপক্ষে পাঁচলাখ ঘরবাড়ি। যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়ে। তিন হাজার ৩৭ কিলোমিটার রাস্তা ব্যবহারের অনুপযোগীসহ ১৩০টি সেতু ভেসে গেছে।
অন্যদিকে, আফগানিস্তানে প্রবল বর্ষণ এবং পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যা রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে নতুন বিপদ ডেকে এনেছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই এমন প্রবলমাত্রার বৃষ্টিপাতের কারণে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে দেশটিকে। সেখানেও এ মৌসুমের বন্যায় প্রাণহানির সংখ্যা দুশ ছাড়িয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অন্তত ৩ হাজার মানুষ। আফগানিস্তান সম্প্রতি একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং চরম আবহাওয়ার শিকার হচ্ছে। এর ওপর আবার চলতি বছরের জুনে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ১ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। তাছাড়া গত আগস্ট মাসেও সেখানে বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছে।
এদিকে, চলতি বছরে মৌসুমি ঝড়ের কবলে থাইল্যান্ডের উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দেখা দেয় প্রবলমাত্রার বন্যা। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ৩০টি জেলায় ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতি হয়েছে। ভেঙে যায় ৩৫টির বেশি বাঁধ। বাঁধ ভেঙে এলাকাগুলোতে কমপক্ষে ২ হাজার মিলিয়ন কিউবক মিটার পানি প্রবেশ করে বলে জানিয়েছে দেশটির পানি সম্পদ বিভাগ। এতে তলিয়ে গেছে কমপক্ষে হাজার দুয়েক ঘরবাড়ি।
বিশ্বের সব দেশেই এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে। ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরার পাশাপাশি দাবদাহ জনিত দাবানলের ঘটনা বিশ্বে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর সে কারণে দাবানলের ভয়াবহতা বাড়ছে। সম্প্রতি গ্রীষ্মের দাবদাহে দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপজুড়ে সৃষ্টি হয় মারাত্মক দাবানল। হাজার হাজার হেক্টর এলাকা পুড়ে যায়। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের প্রাণহানি ঘটে। সম্প্রতি ইউরোপের দুই-তৃতীয়াংশ খরা সতর্কতার অধীনে থাকছে।
তথ্যমতে, গত ৫০০ বছরের মধ্যে এমন পরিস্থিতি দেখা যায়নি ইউরোপে। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, গোটা ইউরোপ জুড়ে ১৭ শতাংশ এলাকাতে গাছপালা মরে বা শুকিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। অন্যদিকে, খরার কারণে বহু নদীর পানি শুকিয়ে গিয়ে প্রাচীন কালের অনেক প্রত্নতত্ত্ব ভেসে উঠছে। ভয়াবহ এই পরিস্থিতি ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু অঞ্চলে আরও কয়েক মাস স্থায়ী হতে পারে। গবেষকরা বলছেন, এসব জলবায়ু পরিবর্তনেরই ফল। এ নিয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়ার কথা বলছেন তারা।
আসছে নভেম্বরে মিসরে জাতিসংঘের কপ–২৭ জলবায়ু সম্মেলন শুরুর আগে জাতিসংঘ ও রেডক্রসের প্রকাশিত এ প্রতিবদেন নিয়ে রেডক্রসের মহাপরিচালক জগান চাপাগাইন বলেছেন, আমরা এটা নিয়ে কোনো নাটকীয়তা করতে চাই না। কিন্তু তথ্য-উপাত্তে এটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, এটা আমাদের একটা অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করছে।
জাতিসংঘের মানবিক বিষয় সংক্রান্ত দপ্তরের প্রধান মার্টিন গ্রিফিথসের মতে, তাপপ্রবাহ, খরা বা বন্যার মতো পরিস্থিতিতে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে উন্নয়নশীল দেশগুলি। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। আগামীতে এ ধরনের বিপর্যয় মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে সতর্ক করা হয়।
জাতিসংঘের ওসিএইচএ ও আইএফআরসির প্রতিবেদনে দাবদাহ–সম্পর্কিত এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় ও ঝুঁকি কমানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, দাবদাহ সংক্রান্ত বিপর্যয় ঠেকাতে এখনই আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, যা এ ধরনের সমস্যার সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাবগুলো কমাতে পারে।