ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাদা সোনায় ধস

সাদা সোনায় ধস

দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী বাজারে ‘সাদা সোনা’ খ্যাত বাগদা চিংড়ির ব্যাপক দর পতন হয়েছে। একমাসের ব্যবধানে প্রকারভেদে দাম কমেছে কেজিতে একশ’ থেকে ৪শ’ টাকা পর্যন্ত। বৈশ্বিক মন্দায় রপ্তানি বন্ধ হওয়া এ দর পতনের মূল কারণ। হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারী কোম্পানিগুলো এখন বাগদা চিংড়ি কিনে স্টোরেজ করে রাখায় মূল্য কম দিচ্ছে। তবে দেশের খোলা বাজারে চাহিদা থাকায় তুলনামূলক ছোট বাগদার দরে কম পতন হয়েছে। দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরেই সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের লক্ষাধিক পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস্য এই বাগদা চাষ। ফলে লোকসানের মুখে পড়ে চিন্তিত চিংড়ি চাষিরা।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ক্রমাগত মাছের খাবারের মূল্যবৃদ্ধি, মাছের পোনার দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে চরম সংকটের মধ্যে রয়েছেন সম্ভাবনাময় এ শিল্পে জড়িতরা। খুলনা কয়রা উপজেলার ২টি মৎস্য আড়তে গিয়ে দেখা যায়, ছোট বাগদা-গলদা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন খুচরা বাজারে পাঠানো হচ্ছে। আর ২০/৩০ টায় কেজির বাগদাগুলো হিমায়িত কোম্পানিগুলোতে পাঠানো হচ্ছে।

জানতে চাইলে কয়রা সদর আড়তের ইনসান আলী নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ইউরোপের দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি চিংড়ি যায়। তবে একমাস হলো কোনো চিংড়ি পাঠাতে পারছেন না বলে আমাদের জানানো হয়েছে। এই কারণ দেখিয়ে কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত দাম কমাচ্ছে। একমাস পূর্বে ৩০ পিসের বাগদা ৯৩০ টাকায় কিনলেও বর্তমানে দিচ্ছে ৫৫৫ টাকা। আর ২০ পিসের বাগদা ১০৮০ টাকার স্থলে ৬৫০ টাকা দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। এছাড়া ছোট বাগদা কোম্পানির চেয়ে দেশের বিভিন্ন খোলা বাজারে বেশি রেটে বিক্রি হওয়ায় আমরা সেখানে পাঠাচ্ছি। তবে খোলা বাজারের দরও বেশ কিছুটা কমেছে।

কয়রার জয়পুর থেকে ওই আড়তে মাছ বিক্রি করতে আসা জামির উদ্দীন বলেন, এলাকা থেকে মাছ কিনে আড়তগুলোতে বিক্রি করি। গতবারের তুলনায় এবছর মাছ কম। আর ছোট বাগদা বেশি পাই।
কয়রার নারায়নপুর আড়তের এক ব্যবসায়ি বলেন, কোম্পানিতে চিংড়ির ভালো দাম পাচ্ছি না। এজন্য চট্রগ্রামে খোলা বাজারে বিক্রির জন্য পাঠাচ্ছি। খোলা বাজারে এক মাসের ব্যবধানে একশ থেকে দেড়শ’ টাকা দাম কমেছে।

একই উপজেলার পশ্চিম দেয়াড়া গ্রামের চাষি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এ বছর চিংড়ি ভালো হয়নি। বিক্রির উপযোগী হওয়ার আগেই অজ্ঞাত কারণে চিংড়ি মারা যাচ্ছে। এরপরে দাম কমায় আরও বিপদে পড়েছি।

একই উপজেলার শ্যামখালী গ্রামের চাষি কার্তিক জানান, অনেকেই এখনও জমির হারির টাকা তুলতে পারিনি। এরই মধ্যে দাম কমে যাওয়ায় চরম হতাশায় রয়েছি। পাইকগাছার শাহিনুর রহমান বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে চাষিরা লাভের মুখ দেখতে পারেন না। যখন বাজারে চিংড়ি বেশি থাকে, তখন কোম্পানির মালিকরা দাম কমিয়ে দেন।

সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার ইয়াসিন মোল্লা বলেন, আগে ৫০/৫৫ পিসে কেজির বাগদা যেখানে ৫৫০ টাকায় বিক্রি করেছি সেখানে এখন পাচ্ছি ৪৫০ টাকা। বাগেরহাটের কচুয়ার চিংড়ি চাষি জাহাঙ্গীর বলেন, ঋণ নিয়ে চিংড়ি চাষ করি। দিন দিন মাছের খাবার ও আনুষঙ্গিক সবকিছুর দাম বাড়লেও বাগদার দাম কমছে। এবার বাগদার উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কম। এরপরও দাম গত দুই বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি থাকায় লাভের স্বপ্ন দেখছিলাম। তবে দাম পড়ে যাওয়ায় চিন্তায় রয়েছি।

মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, খুলনা জেলায় ২০ হাজার ৪৩০টি ঘেরের ৩২ হাজার ৯৯৮ হেক্টর জমিতে এ বছর বাগদা চাষ করা হয়। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ হাজার ৫৪২ মেট্রিক টন বাগদা পাওয়া গেছে। গেল অর্থবছরে উৎপাদন হয় ১১ হাজার ২২৪ মেট্রিক টন। সাতক্ষীরা জেলায় ৬৬ হাজার ৫৯৭টি ঘের রয়েছে। যার মোট আয়তন ৭৮ হাজার ২৪০ হেক্টর।

খুলনাঞ্চলে আশির দশক থেকে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় নোানা পানির চিংড়ি চাষ। এ অঞ্চালের উৎপাদিত চিংড়ির ৯০ শতাংশই ইউরোপসহ বিশ্বের ৩২টি দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। তবে দাম কমে যাওয়ায় বর্তমানে দেশের খোলা বাজারে বেশি বিক্রি হচ্ছে।

বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম সোহেল বলেন, করোনা পরিস্থিতির পর রপ্তানি প্রক্রিয়া এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় চিংড়ির দাম কিছুটা কমেছে। তবে রপ্তানি প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হলে দাম বাড়বে।

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও মাছ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানি খুলনার আছিয়া সী ফুডস্ লিমিটডের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর তরিকুল ইসলাম জহির বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা নেই বললেই চলে। মুদ্রাস্ফীতির ফলে আমরা কোনো অর্ডার পাচ্ছি না। ডলারের বিপরীতে ইউরো, পাউন্ডের দাম ফল্ট করায় তারা কিনছেন না। বিশ্ব মন্দার কারণে দর পতন হয়েছে।

জেলি পুশকৃত চিংড়ি সম্পর্কে তরিকুল ইসলাম জহির বলেন, আমরা পুশকৃত চিংড়ি নেই না। জেলি পুশকৃত চিংড়ির ব্যাপারে আমরা খুবই সতর্কতা অবলম্বন করছি। পুশ যারা করে তারা তো দেশের শত্রু। অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে সামান্য কিছু মিক্সড আসতেও পারে। তবে এ কারণে দামে প্রভাব পড়ছে না।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন