- তিন মাসে ১০ গুন, মূলধন ১৭৪১ কোটি
দুষ্টুদের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুঁজিবাজার। রেগুলেটরদের কঠোর নিয়মেও বাজার থেকে এদের সরানো যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত বেশকিছু কোম্পানির শেয়ার দর অস্বাভাবিক উত্থান-পতন হচ্ছে। এতে দুষ্টদের পকেট ভারী হলেও নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারী। তেমনিই ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার দুষ্টুদের পাল্লায় পড়েছে বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কোম্পানিটির শেয়ার দর পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। দর বৃদ্ধি হয়ে কোথায় যাবে, ধারণা করা যচ্ছে না। অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি ইতোমধ্যে সবাইকে চিন্তায় ফেলেছে। বিষয়টি ভালো ভাবে নেয়নি রেগুলেটরাও। অপরদিকে শেয়ারটির দর কেন বাড়ছে ব্যাখ্যা নেই কোম্পানিটির (ওরিয়ন ইনফিউশন) কর্তৃপক্ষের কাছে।
গত তিন মাসে ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার দর বেড়েছে ১০ গুণ। এ ধরনের বৃদ্ধি, এর আগে কখনই দেখা যায়নি। শেয়ার বৃদ্ধির প্রসঙ্গে মতিঝিলের নামি দামি সাত সিকিউরিটিজ হাউজের বিনিয়োগকারীরা বলছেন, ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার দর সামনে আরও বাড়বে। কেন বাড়বে, সেটা বলতে পারছেন না। তাদের ওইসব কথা শুনে অনেকেই অতি উচ্চদরে শেয়ারটি কিনছে। যদিও কথাগুলো ভিত্তিহীন।
এর আগে ২০২১ সালের ধসের পর বা গত এক যুগে পুঁজিবাজারে অনেক কোম্পানি শেয়ার দর আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। সময়ের পালাক্রমে সেই কোম্পানিগুলোর শেয়ার শুকিয়ে গেছে। কারণ কৃত্রিমভাবে শেয়ার দর যতোই বাড়ুক, একদিন তার আসল রূপে ফিরবে, এটাই স্বাভাবিক। পুঁজির নিরাপত্তা স্বার্থে বিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা সব সময় বলে আসছেন বুঝে, শুনে ও বিশ্লেষণে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করতে। পাশাপাশি পুঁজিবাজার বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে পযাপ্ত পরিমাণে জ্ঞান রাখতে।
একই কথা বলছেন পুঁজিবাজার রেগুলেটরাও। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অতিলোভে পড়ে অর্থ হারানোর গর্তে পা দিচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তেমনি ওরিয়ন ইনফিউশন শেয়ার দর বৃদ্ধির প্রসঙ্গে ওইসব হাউজের কর্মকর্তারা বলছেন, এই শেয়ারটির ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আরও সচেতন হতে হবে। কারণ গত তিন মাসে শেয়ারটির দর বেড়েছে ১০ গুণ। এটা কোনো স্বাভাবিক বৃদ্ধি মধ্যে পড়ে না।
ওরিয়ন ইনফিউশন শেয়ারটির দর আকাশচুম্বী হয়ে পড়েছে। কারণবিহীন লাফিয়ে লাফিয়ে শেয়ারটির দর গত তিন মাসে বেড়েছে ৮৫৫ দশমিক ৬০ টাকা। এ ধরনের বৃদ্ধি মাধ্যমে শেয়ারটির বাজার মূলধন বেড়েছে ১ হাজার ৭৪১ কোটি ৯৮ লাখ ১০ হাজার ৬৫৬ টাকা। শেয়ার দরের এ বৃদ্ধি নিয়ে কোম্পানির শেয়ার ধারন করা বিনিয়োগকারীদের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। যা এই কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ ক্ষেত্রে সুখবর নয়। অপরদিক এ কোম্পানির শেয়ার দর কেন এতো বাড়ছে, তার প্রকৃত কারণ জানে না ধারন করা বিনিয়োগকারীরা।
শেয়ার দর বৃদ্ধির প্রসঙ্গে ওরিয়ন ইনফিউশনের সচিব ফেরদৌস জামানকে মুঠোফোনে কল করেও পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন, শেয়ার দর বাড়ার মতো কোনো মূল্য সংবেদনশীন তথ্য নেই। যা ছিল তা ডিএসইকে জানিয়েছি। এর বাইরে বলার কিছু নেই। অপরদিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক কর্মকর্তা বলেন, শেয়ার দর বৃদ্ধি কারণ জানতে ডিএসই গত আড়াই মাসে পৃথক পৃথক সময়ে মোট চারবার ওরিয়ন ইনফিউশনকে চিঠি পাঠিয়েছে। সর্বশেষ চিঠির জবার গত বুধবারে পেয়েছি। প্রতিটি চিঠির জবাব একই ছিল।
প্রতিবারেই কোম্পানিটি জানিয়েছে, অস্বাভাবিক শেয়ারের বৃদ্ধির জন্য ওরিয়ন ইনফিউশনের কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। এরপর শেয়ারটির দর নিয়ে কাজ করছি। দর বাড়ার কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অতিদরের ব্যাপারে প্রয়োজনে ওরিয়ন ইনফিউশনের বিরুদ্ধে জরুরি ব্যবস্থা নিবো।
শেয়ার দর বৃদ্ধির একই বিযয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, পুঁজিবাজারের কোনো কোম্পানির শেয়ার দর বাড়লো বা কমলো, সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়। আমরা দেখি শেয়ার দর বাড়া বা কমার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা। সেই হিসেবে ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার দর বৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে।
ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার দর বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখতে গত বুধবার ডিএসইকে নির্দেশ দিয়েছে বিএসইসি জানিয়ে মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ডিএসই আগামী ২০ কার্যদিবসের মধ্যে দর বৃদ্ধির কারণ তদন্ত প্রতিবেদন বিএসইসিতে জমা দিবে। তদন্তের ক্ষেত্রে ডিএসই দেখবে কোম্পানিটির শেয়ার দর বৃদ্ধির পেছনে কোনো কারসাজি চক্রের হাত আছে কিনা। এছাড়া শেয়ার ফ্রড ট্রেড, কোম্পানিটির অডিট ও আন অডিট আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়েও দেখতে বলা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন আসার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো জানিয়ে রেজাউল করিম বলেন, ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার দর বাড়ানো ক্ষেত্রে অনিয়ম পাওয়া গেলে, কেবল সেই ক্ষেত্রে কোম্পানির বা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, গত তিন মাসে ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার দর ৯৫ টাকা থেকে বেড়ে সাড়ে নয়শ টাকার ওপরে চলে এসেছে। কোনো কারণ বা কোনো পরিকল্পনায় শেয়ার দর এভাবে বেড়েছে তার কারণ জানা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। নিয়ম অনুসারে কোম্পানির কর্মকর্তারা শেয়ার দর বাড়া-কমার পেছনে কাজ করে না জানিয়ে তারা বলছেন, এটা আমরা জানি। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোম্পানির শেয়ার দর বাড়া-কমায় তাদের (কর্মকর্তা) অদৃশ্য ছোঁয়া থাকে। তাদের ছোঁয়া ছাড়া কোনো কোম্পানির শেয়ার দর লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যায় না। কারণ তারাই জানেন কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য। যেসব তথ্য শেয়ার বাড়া-কমার ক্ষেত্রে জাদুকরি ভূমিকা রাখে। তাই শেয়ার দর বাড়ার জাদুকরি প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন ইনফিউশনের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে পুঁজিবাজার রেগুরেটরকে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত বৃহস্পতিবার ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার দর দাঁড়ায় ৯৫১ দশমিক ৩০ টাকা। এর আগে ১৪ জুলাই কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ৯৫ দশমিক ৭০ টাকা। গত তিন মাসে কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৮৫৫ দশমিক ৬০ টাকা। কোম্পানিটির শেয়ার সংখ্যা ২ কোটি ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭৬০টি। সেই হিসাবে গতকাল বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির মোট শেয়ারের বাজার মূল্যে হয়েছে ১ হাজার ৯৩৬ কোটি ৮২ লাখ ৩৯ হাজার ৬৮৮ টাকা। গত ১৪ জুলাই শেয়ারের বাজার মূল্যে ছিল ১৯৪ কোটি ৮৪ লাখ ২৯ হাজার ৩২ টাকা। এই সময়ের ব্যবধানে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের বাজার মূল্যে বেড়েছে ১ হাজার ৭৪১ কোটি ৯৮ লাখ ১০ হাজার ৬৫৬ টাকা।
ওরিয়ন ইনফিউশনের মোট শেয়ারের মধ্যে ৫১ দশমিক ৮৫ শতাংশ ধারন করেছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ ধারন করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। দশমিক শূন্য শতাংশ ধারন করেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। সেই হিসেবে বিদেশি, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারে বাজার মূল্যে বেড়েছে ১ হাজার ৩৪ কোটি ৫৬ লাখ ২৫ হাজার ৫৪৮ টাকা। এ ধরনের বৃদ্ধি কোনো মতে মানতে রাজি নন বিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা। তাই শেয়ার দর বাড়ার কারণ জানার জন্য সংশ্লিষ্ট রেগুলেটরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে কোনো কোম্পানির মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) ১৫ পয়েন্ট ছাড়ালেই তা বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) মার্জিন ঋণের যোগ্যতা হিসেবে সর্বোচ্চ ৪০ পিই রেশিও বেঁধে দিয়েছে। এ হিসেবে ৪০ পর্যন্ত পিইধারীর শেয়ার বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ বলে জানান বিএসইসি। গতকাল বৃহস্পতিবার ওরিয়ন ইনফিউশনের অডিটেড রিপোর্টে পিই রেশিও দাঁড়ায় ৬৯৪ দশমিক ৩৮ পয়েন্ট। আন-অডিটেড রিপোর্টে পিই রেশিও দাড়ায় ৪৯৮ দশমিক ৯৩ পয়েন্ট। মানে পিই রেশিও হিসাবে, বিনিয়োগ নিরাপদ অবস্থানে নেই। বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ।
ডিএসইর সূত্রমতে, ওরিয়ন ইনফিউশনের তৃতীয় কোয়াটারে (জানুয়রি থেকে মার্চ ২০২২ সাল) শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে দশমিক ৪৫ টাকা। তৃতীয় কোয়টারে হিসেবে (জুলাই ২০২১ সাল থেকে মার্চ ২০২২ সাল) ইপিএস হয়েছে ১ দশমিক ৪৩ টাকা। মার্চ ২০২২ সাল শেয়ার প্রতি সম্পদ (এনএভিপিএস) দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৫৫ টাকা। নগদ প্রবাহ দশমিক ২৬ টাকা। জুন ২০২১ সাল হিসেবে, কোম্পানিটির স্বল্পমেয়াদে ২৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকার লোন রয়েছে। বর্তমানে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ২০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা এবং রিজার্ভ ৬ কোটি ২ লাখ টাকা। শেয়ার সংখ্যা ২ কোটি ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭৬০টি। কোম্পানিটি মোট শেয়ারের ৪০ দশমিক ৬১ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালক একাই ধারন করেছে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, বিদেশি দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ ও সাধারন বিনিয়োগকারী ৫১ দশমিক ৮৫ শতাংশ শেয়ার ধারন করেছে।
১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ওরিয়ন ইনফিউশন। প্রথম দিকে কোম্পানিটির নাম ছিল ‘মালা কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’। ১৯৯৪ সালে নাম পরিবর্তন করে ‘ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেড’ করা হয়। এরপর একই বছরে কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়।
আনন্দবাজার/শহক