সহজ হবে শিল্পের অর্থায়ন
দেশে বন্ড মার্কেট জনপ্রিয় করা গেলে ব্যাংকের ওপর থেকে ঋণ নির্ভরতা কমবে। বন্ডের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের বিকল্প উৎস তৈরি করা গেলে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিও কমে আসবে। অন্যদিকে শিল্পায়নের গতিও বাড়বে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে এফবিসিসিআই কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বন্ড মার্কেট: দ্য আল্টিমেট সলিউশন ফর লং টার্ম ফাইন্যান্সিং শীর্ষক সেমিনারে এসব মন্তব্য করেন সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।
স্বাগত বক্তব্যে জসিম উদ্দিন বলেন, দেশে শিল্পখাতে দীর্ঘমেয়াদী ঋণদানের জন্য কোন প্রতিষ্ঠান নেই। ব্যাংকগুলোর জন্য স্বল্প মেয়াদে আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দেয়া কঠিন। ব্যাংকের স্বল্পমেয়াদী ঋণই খেলাপি বাড়ার মুল কারণ বলে মনে করেন সভাপতি। তিনি জানান, স্বল্প মেয়াদী ঋণ নিয়ে শিল্প চালুর আগেই অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন উদ্যোক্তারা। এক্ষেত্রে অনেক প্রতিষ্ঠান অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেলাপি হয়ে যায়। তাই দীর্ঘমেয়াদী ঋণের বিকল্প উৎস হিসেবে বন্ড মার্কেট অপরিহার্য।
সেমিনারের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এমপি বলেন বাংলাদেশের পুঁজিবাজার শুধুমাত্র ইক্যুইটি মার্কেট নির্ভর ছিলো। কোন বন্ড মার্কেট ছিলোনা। যে কোন দেশের পুঁজিবাজার শক্তিশালী হতে হলে দুটি মার্কেট থাকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশেও বন্ড জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে দেশে বন্ড মার্কেট জনপ্রিয় করার জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি ও বন্ডের দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ।
এসময় উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান জানান, দেশে ব্যবসায়ীক পরিবেশ উন্নত করতে সরকারি সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রনমূলক কার্যক্রম ও সেবাকে সহজ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)’র চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম জানান, এরইমধ্যে পুঁজিবাজারে পারপেচুয়াল বন্ডের লেনদেন শুরু হয়েছে। অন্যান্য বন্ডের লেনদেন শুরু হলে এর জনপ্রিয়তা বাড়বে। আইএফসি বাংলাদেশে ৪ বিলিয়ন ডলারের বন্ড ছাড়তে চায় বলে জানান বিএসইসি চেয়ারম্যান।
ভবিষ্যতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অরেঞ্জ বন্ড, ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য পিংক বন্ড চালুর পরিকল্পনা ও নতুন উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের জন্য স্টার্টআপ বোর্ড তৈরির কাজ চলছে বলে জানান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। সেমিনারে বন্ড মার্কেট জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে সব ধরনের সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দেন এফবিসিসিআই’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড এর ভাইস চেয়ারম্যান আরিফ খান সিএফএ, এফসিএমএ। তিনি জানান বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাতে বন্ড মার্কেট মাত্র ৮ শতাংশ। যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।
মূল প্রবন্ধে বন্ড জনপ্রিয় হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে জটিল ও সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, ব্যাংক সুদের হারের উত্থান পতন, ট্রাস্টি নিবন্ধনে অনেক বেশি নিয়মকানুনকে চিহ্নিত করা হয়। পুঁজিবাজারে বন্ডের লেনদেনের সর্বনিম্ন আকার ১ লাখ টাকা। এবং লেনদেন ফি ১ হাজার টাকা জানিয়ে বন্ডের লটের আকার ছোট করার পরামর্শ দেয়া হয় সেমিনারে।
প্যানেল আলোচনায় সেন্ট্রাল ডিপোসিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল)’র এমডি ও সিইও শুভ্র কান্তি চৌধুরী, এফসিএ বলেন, দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের জন্য বিশ্বের সবদেশেই বন্ড জনপ্রিয়। কিন্তু বাংলাদেশে বন্ডের সেকেন্ডারি মার্কেট না থাকায় জনপ্রিয় হচ্ছে না। তবে মঙ্গলবার (আজ) থেকে পুঁজিবাজারে বন্ডের লেনদেন শুরু হয়েছে।
ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, পুঁজিবাজারে লেনদেনে আসা বন্ডে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নিয়ম কানুন আরো সহজ করার তাগিদ দেন।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ)’র সাবেক সভাপতি মোহাম্মেদ নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে অর্থায়নের জন্য ১০ বছরের অধিক মেয়াদী বন্ড জনপ্রিয় করতে হবে। কর্পোরেট বন্ডে করছাড়সহ নীতি সহায়তা দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। বন্ডের লেনদেনের চার্জ ও ডিপোজিটরি চার্জ প্রথম দিকে যতটা পারা যায় সহনীয় করার পরামর্শ দেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)’র শেয়ারহোল্ডার ডিরেক্টর শাকিল রিজভি।
এফবিসিসিআই’র পরিচালক ও পুঁজিবাজার ও বন্ড সম্পর্কিত স্টান্ডিং কমিটির ডিরেক্টর ইন-চার্জ আমজাদ হোসাইন বলেন, সম্প্রতি ইস্যুকৃত বেশিরভাগ বন্ডের মাত্র ১০ শতাংশ সাধারণ মানুষের জন্য রাখা হয়েছে। বাকি ৯০ শতাংশ প্রাইভেট প্লেসমেন্ট, যেটা সাধারণভাবে লেনদেন হয়না। প্রাইভেট প্লেসমেন্টগুলোকে একটি নির্দিষ্ট লকিং পিরিয়ডের পর পাবলিক ট্রেডিং করার পরামর্শ দেন তিনি। একটি ব্যাংক যখন আরেকটি ব্যাংকের বন্ড কেনে তখন স্পেশাল পারপাস ভেহিকেল বা এসপিভির দরকার হয়না। কিন্তু কর্পোরেট বন্ড সাবস্ক্রাইব করতে হলে এসপিভির দরকার হয়। এই বিধানটি পুন:বিবেচনার আহ্বান জানান আমজাদ হোসাইন।
উন্মুক্ত আলোচনায় এরইমধ্যে চালুকৃত বিভিন্ন কর্পোরেট বন্ডের পর্যালোচনা মূল্যায়ন করা, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে সংযুক্ত করা, সুনাম রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ডে আগ্রহী করে তোলার ব্যাপারে পরামর্শ দেন বক্তারা। সেমিনারে অন্যান্যদের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি আমিন হেলালী, হাবীব উল্ল্যাহ ডন, এম এ রাজ্জাক খান রাজ ও পরিচালকবৃন্দ। সেমিনার সঞ্চালনা করেন এফবিসিসিআই’র মহাসচিব মোহাম্মদ মাহফুজুল হক।