- লাগামছাড়া ধনেপাতা
- শিমের দাম কমেছে
- অপরিবর্তিত টমেটো, বরবটি
- ডিমের দাম আগের মতো
সবজির বাজার বর্তমানে আগুন। নানা ছুঁতোয় বেড়েছে দাম। চড়া দামের কারণে সবজি বিক্রি কমেছে। ক্রেতাও কমেছে। যেখানে আগে শুধুমাত্র শুক্রবারে একটি সবজির দোকানে ৮০ থেকে ৭০ হাজার টাকার বিক্রি হতো, সেখানে ওই দোকানে শুক্রবারেই সবজি ৪০ ভাগ বিক্রি কমেছে। আবার অনেক ব্যবসায়ীরা পরিমাণ কম আনার পরও সবজি থেকে যাচ্ছে। তখন অবিক্রিত সবজি পরের দিনের রেখে দেওয়া হচ্ছে। এখন পরেরদিন যদি বাজারের দাম পড়ে যায়। তবে তখন কম দামে সবজি ছেড়ে দিতে হচ্ছে। কারণ সবজি বেশি দিন টাটকা রাখা যায় না। টাটকা না পেলে ক্রেতারাও কিনে না। সবকিছু মিলিয়ে সবজি কম বিক্রি হলেও চড়া দাম নিয়ে পুষিয়ে নিচ্ছেন সবজি ব্যবসায়ীরা। গতকাল শুক্রবার বিভিন্ন বাজার ঘুরে সবজি ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনায় এমন তথ্য ওঠে এসেছে।
সবজি কম আনলেও থেকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কাপ্তানবাজারের ব্যবসায়ী রানা। তিনি বলেন, কিছুদিন আগেও দৈনিক ৭০ হাজার টাকা সবজি আনা হতো। সেই সবজি দিনেই বিক্রি হয়ে যেত। বর্তমানে ৪৫ হাজার টাকার সবজি আনা হচ্ছে। বেশিরভাগ দিন সবজি থেকেও যাচ্ছে। বিক্রি না হলে পরের দিনে জন্য সংরক্ষণ করে রাখা হচ্ছে। সবজি দামের প্রসঙ্গে রানা আরও বলেন, যে দামে সবজি আনা হচ্ছে, তার থেকে সামান্য লাভে বিক্রি করছি। এখন চড়া দামে আনলেও তার থেকে সামান্য লাভেই বিক্রি করছি। আমাদের লাভ সীমিত। প্রতি কেজিতে আগে ৮ থেকে ১০ টাকা লাভ করেছি, এখনও সেই পরিমাণে লাভ করছি। তবে পরিবহন ব্যয় বাদ দিলে লাভ আরো কমে যাবে।
একই বাজারের আরেক সবজি ব্যবসায়ী শুকুর আলী সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, বাজারে ক্রেতার পরিমাণ কম। বিক্রি কম। আগে ৫০ হাজার টাকা সবজির পসরা নিয়ে বসেছি। সেখানে বর্তমানে ৩৪ হাজার টাকার সবজি নিয়ে বসেছি। তাও বিক্রি হচ্ছে না। সামান্য লাভে বিক্রি করছি জানিয়ে তিনি বলেন, শীতের সবজি বাজারে আসা শুরু করছে। তাই বাজারের শীতকালীর সবজি চাহিদা বেশি। চাহিদার কারণে হয়তো দাম কিছুটা বাড়তি। সরবরাহ কম থাকলে সেটি দাম এমনিতেই একটু বেশি থাকে। অন্যসব সবজি আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে।
ঢাকায় সবজির দামের চড়ার জন্য কৃষক ও পাইকারেরা খুচরা ব্যবসায়ীদের দুষছেন জানিয়ে কাওরানবাজারের সবজি ব্যবসায়ী জামসেদ বলেন, যশোর ও বগুড়া থেকে ঢাকার বাজারে শীতের সবজির সরবরাহ কমেছে। অনেকেই সবজি বেচে লাভ কম পাচ্ছে। ঢাকায় সবজি চড়া হলেও কৃষকরা পাচ্ছে সামান্য। এছাড়া উত্তরাঞ্চলে বন্যা কারণে সবজির চাষ কম হওয়ায় এবং ফলন বিপর্যয়ে বাজারে সরবরাহের ঘাটতি পড়েছে। যে কারণে দাম বেড়েছে। সামনে আরো বাড়তে পারে। অভিযোগ রয়েছে, কয়েক হাত ঘুরে সবজি বেচাকেনার কারণে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দামের রয়েছে অস্বাভাবিক। একারণে ভোগান্তিতে পড়েন ভোক্তারা, দাম কম পান কৃষকরা, কিন্তু লাভবান হন মধ্যস্বত্বভোগীরা। এছাড়া দাম বাড়ার জন্য ব্যবসায়ীরা কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছে। এগুলো হলো সার বৃদ্ধি, জ্বালানির বৃদ্ধি এবং বাড়তি সেচের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া। সেই বেড়ে যাওয়া অনুসারে কৃষকরা রেট পাচ্ছে না।
এদিকে, মূলত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই চড়া সবজির বাজার। প্রায় সব সবজির দামই কমবেশি বেড়েছে। গত ৫ আগস্ট রাতে দেশে জ্বালানি (ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল, কেরোসিন) তেলের দাম লিটারে ৪২ থেকে ৫২ ভাগ পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। তার দুই-এক দিন পর থেকেই তার প্রভাব পড়ে রাজধানীর কাঁচাবাজারে। সম্প্রতি জ্বালানির দাম লিটারে পাঁচ টাকা করে কমিয়েছে। বর্তমানে এই দাম কার্যকর হয়। জ্বালানির দাম কমলে তার প্রভাব পড়েনি সবজির বাজারে।
পাইকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, ৫ আগস্টে জ্বালানি নতুন দাম কার্যকরের পর ট্রাকভাড়া বেড়ে যাওয়ায় সবজির কেজিতে ২ টাকা বেশি গুনতে হয়েছিল। তবে খুচরা বাজারে যেভাবে বেড়েছিল, সেটা রীতিমতো অন্যায়। সম্প্রতি সরকার জ্বালানির দাম কমিয়েছে। পূর্বে জ্বালানির দাম বেড়েছিল সর্বোচ্চ ৫২ টাকা। কিন্তু কমিয়েছে ৫ টাকা। যেটা বাড়ানোর তুলনায় কমানো খুবই সামান্য। যা বাজারে কমার ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখবে না। এটাই স্বাভাবিক। সামনে সবজির দাম আরো বাড়তে পারে এমন আভাস দিয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, কারণ সামনে শীতের সবজি মৌসুম আসছে। সেখানে শীতের সবজি বীজ বপন করা হয়েছিল। কেবল চারাগুলো গজিয়ে বড়ও হয়েছিল। এমন সময় দেশের উত্তর অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিত চরমে। এতে নষ্ট হয়েছে জমির ফসল। তার প্রভাব আমাদের কাঁচা বাজারে পড়বে।
দাম বৃদ্ধির প্রসঙ্গে উল্টো কথা বলছেন কাওরানবাজারের ব্যবসায়ী ফারুক, সব কিছুর দাম লাগারের মধ্যে রয়েছে। কিছু দাম বেড়েছে। পরিবহন ও বেশি দামে কেনায়, বাড়াতে বাধ্য হয়েছি। আবার সবজি কম আসায় বেশি দাম দিয়ে আড়ৎ থেকে কিনতে হচ্ছে। তবে সরবরাহ বাড়লে দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। এছাড়া বন্যার প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজারে।
হাতিলপুর কাঁচাবাজারে কথা হয় চাকরিজীবি আজমী চৌধুরী সঙ্গে। তিনি বলেন, শুক্রবার সংসারের অনেক কাজ গুজিয়ে করতে। যেহেতু চাকরি করি, তাই এদিনে সাপ্তাহিক বাজার করে থাকি। বরাবারের মতো এবারে বাজারে এসেছি। বাজারও করেছি। বর্তমান বাজার দর অতি বাড়তি। গত সপ্তাহে (২৩ সেপ্টেম্বর) যেখানে দুই হাজার টাকার বাজার করেছি। সেই পরিমাণ বাজার করতে এবারে সাড়ে তিন হাজার টাকায় ঠেকেছে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, সপ্তাহের ব্যবধানে বেশির ভাগ সবজির দাম অপরিবর্তিত। দামের দাপটের শীর্ষে রয়েছে ধনে পাতা। প্রতি কেজি ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এরপর দামের শীর্ষে রয়েছে গাজর। প্রতি কেজি গাজর ১৬০ (চায়না) টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে দেশি গাজর প্রতি কেজি ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দামের বৃদ্ধির তালিকায় এগিয়ে আছে শিম। প্রতি কেজি বিট আলু ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। শীর্ষ দামের সঙ্গী হিসেবে রয়েছে টমেটো। প্রতি কেজি ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। শীর্ষ দামের সঙ্গে রয়েছে বেগুন (গোল)। প্রতি কেজি ১০০ (গোল) টাকায় বিক্রি হয়েছে। লম্বা বেগুন কিছু কমে পাওয়া যাচ্ছে।
সপ্তাহের ব্যবধানে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ডিম। দামের দিক দিয়ে সঞ্চুরির পথের কাছাকাছিতে রয়েছে করলা, লতি, কহি এবং বটবটি মরিচ। এসব প্রতি কেজি ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে ডাবল সেঞ্চুরির ওপরে থাকা কাঁচা মরিচের দাম নেমেছে অর্ধেকের নিচে। কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজধানীর বাজারগুলো প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ৭০ টাকার মধ্যে ছিল। কিন্তু গতকাল মরিচের দাম বাড়তি লক্ষ্য করা গেছে। প্রতি কেজি মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। মরিচের ঝালের সাথে সামান্য বাড়লো শসা। তবে গরুর মাংস, খাসি মাংস ও মুরগীর (পাকিস্থানি) দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। স্থানভেদে প্রতি কেজি দামে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।
চড়া দাম প্রসঙ্গে শনিরআখড়ায় সবজি ব্যবসায়ী রনি বলেন, এখন ধনে পাতা, টমেটো ও শিমের মৌসুম না। এগুলো শীতের সবজি। কিন্তু বাজারে চাহিদা রয়েছে। চাহিদা থাকায় ধনে পাতা প্রতি কেজি দুইশ এবং শিমের দাম কেজি প্রতি ১৩০ টাকা। কাপ্তানবাজারের ব্যবসায়ী নুরুল হক বলেন, চাহিদার তুলনায় কম গাজর ও বটবতি বাজারে রয়েছে। যেহেতু বাজারে সরবরাহ কম, সেহেতু দাম বেশি এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে বাজারে গজর প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা। বটবতি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০ টাকা।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন খোলাবাজার সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে রাজধানীর ফার্মের ডিমের হালি ৫০ (লাল) টাকা। পাইকারি বাজারের প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১১ দশমিক ১০ টাকা। দেশি ডিমের হালি ৭০ টাকা। হাঁসের ডিম হালি ৮০ টাকা। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি করছেন ১৮০ টাকায়। আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর মুরগির কেজি ২০০ টাকা উঠেছিল। বেড়েছে পাকিস্তানি কক বা সোনালী মুরগির দাম। বর্তমানে মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩১০ থেকে ৩২০ টাকায়। খোলা বাজারে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৮০ টাকা এবং সরিষার তেল ২৫০ টাকা। প্রতি কেজি চাল মোটা ৪৫ টাকা, আটাশ ৫৫ টাকা এবং চিকন ৭৫ টাকা। মসুর ডাল দেশি ১৩০ টাকা এবং ইন্ডিয়ান ১০৫ টাকা। রসুন প্রতি কেজি দেশি ৮০ টাকা এবং ইন্ডিয়ান ১৩০ টাকা। আদা প্রতি কেজি ১৬০ (চায়না) টাকা।
খুচরা বাজারে শসা ৬০ টাকা প্রতি কেজি। ঢেঁড়শের প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। সপ্তাহের ব্যবধানে দাম পেঁয়াজ বাড়লেও আলুর দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। পেঁয়াজ কেজি প্রতি ৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আলুর কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। এছাড়া মিষ্টি কুমড়া ৫০ টাকা, পেঁপের ৩০ টাকা, পটল ৬০ টাকায় কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। কচুর ঘাডি এবং চিচিঙ্গা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। এছাড়া ঝাল কুমড়া ৫০ টাকা, প্রতিটি ফুলকপি ৫০ টাকা, পাতাকপি ৫০ টাকা এবং লাউ ৬০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। তবে এগুলো সাইজের ওপরে দাম কমবেশি রয়েছে।