বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের। এ সম্পর্ককে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে বিষয়টিকে ভিত্তি ধরে অর্থনৈতিক কূটনীতি বিষয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করছে দৈনিক আনন্দবাজার। আজ বাংলাদেশ-ভুটানের সম্পর্ক নিয়ে “ভুটানে ছন্দহীন রপ্তানি-বাণিজ্য” শীর্ষক দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হলো।
ভুটানের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের কোন স্থিরতা নেই। হয়তো এ বছর মাছ ও ফল জাতিয় খাবার রপ্তানি হলো। পরের বছর এটির আর দেখা নেই। যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু পণ্য। আগেরটি গেছে হারিয়ে। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের রপ্তানি পণ্যের বাজার বিশ্লেষণ করলে এই চিত্রই দেখা যায়। নদীর জোয়ার-ভাটার মতোই ভুটানে পণ্য রপ্তানি করছে ব্যবসায়ীরা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি’র ৫ বছরের বাজার চিত্রটি অনেকটা এ রকম। ১৮ নং কোডের পণ্যটি ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৩৪৩৫.৯৮ ও ১৬৩৪৬.৩৬ মার্কিন ডলার কিন্তু ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত এসব পণ্য আর রপ্তানি হয়নি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মাছ ও কাকড়া জাতিয় পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১৮১৯.৪৪ মার্কিন ডলার কিন্তু পরবর্তী তিন বছর আর এসব পণ্য রপ্তানি হয়নি। ২০১৬ থেকে ২০২১ অর্থবছরে খনি-খননের যন্ত্রপাতি রপ্তানি হয়েছে মাত্র দুইবার। এভাবে হিসেব করলে দেখা যায় রপ্তানি বাজারে স্থিরতা খুবই কম অর্থাৎ অস্থির পণ্যবাজার।
২০২০-২১ অর্থবছরে কাঁচ ও কাঁচপাত্র রপ্তানি করা হয়েছে ৫১,০১২.৪১ মার্কিন ডলার। অ্যালুমিনিয়াম ৫২২,৩৩০ ও প্লাস্টিক এবং এর সামগ্রী ৭৬৪,২৩২ মার্কিন ডলার।
ভুটানের সঙ্গে ১৯৮০ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক চুক্তি হলেও দেশটিতে পণ্যরপ্তানির তথ্য পাওয়া যায় ১৯৮৭-৮৮ অর্থবছর থেকে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি’র বার্ষিক প্রতিবেদনে সেই অর্থবছরে ১ মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানির হিসেব লিপিবন্ধ আছে। সেটি ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে ৫৫ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি’র গবেষণা কর্মকর্তা (পরিসংখ্যান ও গবেষণা) মোঃ মেহেদুন্নবী দৈনিক আনন্দবাজারকে জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভুটানে যেসব পণ্য রপ্তানি করেছে তারমধ্যে রয়েছে ১. তুলা এটি ৫২ নং কোডের পণ্য। ৬১ নং কোডে রয়েছে ২. পোশাক, ৩. পোশাকের জিনিসপত্র, ৪. বোনা বা ক্রোশেটেড। ৬৩ নং কোডে তৈরি টেক্সটাইল; ৫. সেট জীর্ণ পোশাক এবং ৬. টেক্সটাইল। ৭৩ নং কোডে ৭. লোহা বা ৮. ইস্পাত। ৮ নং কোডে ৯. ভোজ্য ফল এবং ১০.বাদাম, ১১. সাইট্রাস ফল। ১১ নং কোডে মাইলিং শিল্পের পণ্য; ১২. মাল্ট স্টার্চ, ১৩. ইনুলিন; ১৪. গমের গ্লুটন। ১৭ নং কোডে ১৫. চিনি এবং চিনি মিষ্টান। ১৯ নং কোডে ১৬. সিরিয়াল, ১৭. ময়দা, ১৮. মাড়। ২০ নং কোডে ১৯. শাকসবজি, ফল, বাদাম বা উদ্ভিদের অন্যান্য অংশ প্রস্তুত করা। ২১ নং এ ২০. বিবিধ ভোজ্য। ২২ নং কোডে ২১. পানীয়। ২৬ নং কোডে রয়েছে ২২. আকরিক, ২৩. স্ল্যাগ এবং ২৪. ছাই। ৩০ নং পণ্যে রয়েছে ২৫. ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য। ৩৪ নং কোডে ২৬. সাবান, ২৭. ওয়াশিং, ২৮. কৃত্রিম বা প্রস্তুত মোম, পলিশিং বা স্কোরিং প্রস্তুতি, মোমবাতি এবং অনুরূপ, মডেলিং পেস্ট, দাঁতের মোম।
তিনি জানান, ৩৯ নং কোডের পণ্যের মধ্যে রয়েছে ২৯. প্লাস্টিক এবং এর সামগ্রী। ৪৮ নং কোডে ৩০. কাগজ বা পেপারবোর্ড; কাগজের সজ্জা, কাগজ। ৬২ নং কোডে ৩১. পোশাক, ৩২. পোশাকের জিনিসপত্র। ৭০ নং কোডে ৩৩. কাচ এবং কাচপাত্র। ৭৬ নং কোডে ৩৪. অ্যালুমিনিয়াম। ৮৪ নং পণ্যের মধ্যে রয়েছে ৩৫. পারমাণবিক চুল্লি, ৩৬. বয়লার, ৩৭. যান্ত্রিক যন্ত্রপাতি। ৮৫ নং কোডে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম এবং তার অংশ; ৩৮. সাউন্ড রেকর্ডার, ৩৯. রিপ্রডিউসার, ৪০. টেলিভিশন ইমেজ এবং সাউন্ড রেকর্ডার। ৯৪ নং কোডের পণ্যের মধ্যে রয়েছে আসবাবপত্র তথা ৩৯. বিছানাপত্র, ৪০. গদি, ৪১. কুশন, ৪২. বাতি এবং আলোর জিনিসপত্র ইত্যাদি।
২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভুটান অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) স্বাক্ষরের ফলে চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া বাংলাদেশের পণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাকশিল্প, সিমেন্ট, চা, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী যেমন- জুস, কনডেন্সড মিল্ক, বিস্কুট, মিনারেল ওয়াটার, পাউরুটি, কৃষিজাতপণ্য আলু, প্রসাধনসামগ্রী, টয়লেট্রিজ পণ্যের মধ্যে সাবান ও শ্যাম্পু, শুঁটকি মাছ, প্লাইউড, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং।
এছাড়া জ্যাকেট, ব্লেজার, ট্রাউজার, আন্ডারওয়্যার, বাচ্চাদের পোশাক, চকলেট, বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য, গার্মেন্টস পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, অ্যালুমিনিয়াম ডোর, কাঠের তৈরি পণ্য, ইলেকট্রনিকস পণ্য, ফুটওয়্যার, ক্যাবলস, ঘড়ি, বেল্ট, মেটাল ও প্লাস্টিক ফার্নিচার ইত্যাদি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। আর ভুটান থেকে বোল্ডার, জিপসাম, ডোলোমাইট, ফল ও জুস, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য যেমন জ্যাম ও জেলি, মসলা, ফার্নিচারসহ অন্যান্য পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছে।
বাংলাদেশে ভুটানের ১৬টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে দুধ, প্রাকৃতিক মধু, গম বা মেসলিনের আটা, জ্যাম, ফলের জেলি, মার্মালেড, সিমেন্ট ক্লিংকার, পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট, সাবান, পার্টিকেল বোর্ড, ফেরো সিলিকন, লৌহ অথবা নন-আলয় স্টিলের বার এবং রড, মিনারেল ওয়াটার, গমের ভুসি, কাঠের আসবাবপত্র ইত্যাদি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভুটানে ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরের চেয়ে আড়াই গুণ রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছর ১৪০ মার্কিন ডলার হয়। ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে তা কমে নেমে আসে ৫৬ ডলারে। ভূমিধ্বস হয় ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর। অর্থাৎ নেমে আসে মাত্র ৩ মার্কিন ডলারে। কিছুটা বেড়ে ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে ৪৭ ও ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে ২৪ মার্কিন ডলার হয়। তবে ঊর্ধ্বমুখি হয়ে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে ৪৬৩ মার্কিন ডলার হয়। প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে ৭৭৯ মার্কিন ডলারে চলে আসে। ২০০০-০১ অর্থবছর থেকে নতুন উদ্যোমে চলে বাণিজ্যিক সম্পর্ক। দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে উন্নীতি। এ বছর রপ্তানি গিয়ে দাঁড়ায় ১১৮১ মার্কিন ডলারে। ২০০১-০২ অর্থবছরে ১৬৭৩ মার্কিন ডলার। কিছুটা কমে ২০০২-০৩ অর্থবছরে ১৫৭৪ মার্কিন ডলার হয়। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে আরো কমে ১৩৭৪ ডলারে আসে। তবে ২০০৪-০৫ অর্থবছরে আবার বাড়তে শুরু করে। তখন ৫১০৪ ডলারে উঠে। সমুদ্রহীন দেশটিতে বাণিজ্যের ঢেউ আর স্থির থাকে না। আবারো ভাটা শুরু হয়। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ১৭২৪, ২০০৬-৭ অর্থবছরে ১৩৯৮ এবং ২০০৭-৮ অর্থবছরে ১২১৩ ডলার হয় রপ্তানি। আবারো ভূমিধ্বস ২০০৮-৯ অর্থবছরে, রপ্তানি হয় মাত্র ৬০৭ ডলার।
ইপিবি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, তবে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ঘোড়ার শক্তি চলে আসে রপ্তানি বাণিজ্যে। সেই বছর রপ্তানি হয় ২২৪০ মার্কিন ডলার। ২০১০-১১ অর্থবছরে ৩১২১ ডলারে চলে আসে। তিন গুণ বেড়ে যায় ২০১১-১২ অর্থবছরে। তখন রপ্তানি ছিল ৯১৩১ মার্কিন ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কমে ৪৭৪৪ মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৩৫৫.৮২ মার্কিন ডলার বা ৪.৩৬ মিলিয়ন ডলার হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৮৮৯.১৯ মার্কিন ডলার বা ৬.৮৯ মিলিয়ন ডলার হয়। ২.৬৭ ডলার বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি দাঁড়ায় ৯.৫৬ মিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ ভুটানের সঙ্গে রপ্তানি-বাণিজ্য সম্পর্ক প্রতিনিয়ত চলছে হেলেধুলে। এই কখনো ঊর্ধ্বমুখি আবারো নেমে পড়েছে গিরিখাদে। সেখান থেকে হয়তো আবার কাব্বাইতে কাব্বাইতে উঠে দাঁড়িয়েছে মাত্র। হোঁচট খেয়ে নেমে গেছে পাহাড়ের নিচে। আবার পা টিপতে টিপতে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে চেয়েছে ভুটানে বাংলাদেশের রপ্তানি।