নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দেয়ার বিষয়ে একমত নয় কৃষিমন্ত্রী মো. আবদুর রাজ্জাক
প্রতিনিয়তই বাড়ছে নিত্যপন্যের দাম। রাশিয়া-ইউক্রেণ যুদ্ধের অযুহাতে দাম বেড়েছে দফায় দফায়। তেলের মূল্যবৃদ্ধির অযুহাতেও বেড়েছে দাম। নানা অযুহাতে প্রায় সবধরণের খাদ্যপণ্য গত কয়েকমাস ধরে উর্ধমূখী। মূল্যবৃদ্ধি নামক পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানাই যেনো দায়। জনসাধারণের বাজারে যাওয়াই যেনো মানা। সরকারের নানা পদক্ষেপেও বাজারে ফিরছে না সস্তি। অভিযোগ রয়েছে এর পেছনে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এবার মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানতে নয়টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নির্ধারণ হবে নতুন এ দাম। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চাহিদার বিপরীতে সরবরাহের ঘাটতি থাকায় দিন দিন দাম বেড়েই চলেছে। লাগাম টানতে হলে সরবরাহ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
জানা গেছে, ভোজ্যতেল ও চিনির পাশাপাশি চাল, আটা, ময়দা, মসুর ডাল, ডিম, সিমেন্ট ও রডের দামও নির্ধারণ করে দেবে সরকার। এই পণ্যগুলোর দাম কী হওয়া উচিত তা নির্ধারণ করতে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নির্ধারিত দামে বিক্রি করা না হলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে মামলা। ট্যারিফ কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ৯ পণ্য সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি পাঠানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে অধিকাংশ পণ্য সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সব পণ্যের তথ্য এখনো আসেনি। তথ্য-উপাত্ত পেলে তা বিশ্লেষণ করে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। বৈঠকের মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করা দেয়া হবে।
এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। মন্ত্রী বলেন, দেশের বাজারে নয়টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেবে সরকার। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আগামী সাতদিনের মধ্যে নির্ধারণ হবে নতুন এ দাম। পণ্যের দাম নির্ধারণে ১৫ দিন অতিক্রম হয়েছে। আগামী সাতদিনের মধ্যে দামের নতুন তালিকা প্রকাশ করা হবে। মুরগির খাদ্য, পরিবহন খরচ ও অন্যান্য দাম বিবেচনায় রেখে ডিমের দাম যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করে দেয়া হবে। এছাড়া খাদ্যপণ্য, তেল ও স্টিলসহ আরও বেশ কিছু পণ্যের দাম নির্ধারণ হবে।
কেন দাম বাড়ছে? আর কেনই বা দাম বাড়ার গতিতে লাগাম টানা যাচ্ছে না? কোথাও মিলছে না সন্তোষজনক উত্তর। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চাহিদার বিপরীতে সরবরাহের ঘাটতি থাকায় দিন দিন দাম বেড়েই চলেছে। লাগাম টানতে হলে সরবরাহ বাড়ানোর বিকল্প নেই। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কিছু পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি করতে হচ্ছে বেশি দামে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পুরো বাজারব্যস্থাই সিন্ডিকেটের দখলে। যাদের কাছে সরকারকেও মনে হচ্ছে অসহায়। তবে একাধিক মন্ত্রীর দাবি, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যে হারে বেড়েছে সে তুলনায় দ্রব্যমূল্য বাড়েনি। অর্থাৎ মূল্য এখনো মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম এক বছরে আট শতাংশ বাড়লেও দেশের বাজারে খোলা ময়দা ও আটার দাম বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। মসুর ডালের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও দেশের বাজারে ২৯ থেকে ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্ববাজারে স্টিল স্ক্র্যাপের দাম কলেও দেশের বাজারে রডের দাম বেড়েছে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই সরকার এসব পণ্যর দাম বেঁধে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি বিশ্লেষণ করে দাম নির্ধারণ করে দেয়া হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সব পর্যালোচনা করে ৯টি পণ্যের দাম ঠিক করে দেবে। দাম নির্ধারণের পর আমাদের কাজ হবে বাজারে তার প্রভাব কীভাবে পড়ছে তা দেখা।
গত বুধবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, এতদিন ট্যারিফ কমিশন শুধু ভোজ্যতেল ও চিনির মূল্য নির্ধারণ করে দিত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ পণ্যগুলোর দাম কয়েকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে, যা হওয়া উচিত ছিল না। বিষয়গুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ধারাবাহিকভাবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাজারে স্থিতিশীলতা তৈরি করা যায়নি। এমন প্রেক্ষাপটে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোর সব স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে এই বৈঠক করেছে।
বৈঠকে সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে তখন তিনি বলেছিলেন, এখন থেকে ভোজ্যতেল ও চিনির পাশাপাশি চাল, আটা, ময়দা, মসুর ডাল, ডিম, সিমেন্ট ও রডের দামও নির্ধারণ করে দেবে সরকার। সার্বিক বিবেচনায় এই পণ্যগুলোর দাম কী হওয়া উচিত তা নির্ধারণ করতে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এসব পণ্যের সব পর্যায়ের অংশীজনদের নিয়ে আলোচনা করে যথাযথ দাম নির্ধারণ করবে। নির্ধারিত দাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে। সরকার নির্ধারিত এই দাম কোনো স্তরের ব্যবসায়ী পর্যায়ে লঙ্ঘিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জরিমানার পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। বর্তমানে মজুত, কারসাজি কিংবা কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে বাড়তি দাম রাখার ক্ষেত্রে বর্তমান আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
তবে নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দেয়ার বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন কৃষিমন্ত্রী মো. আবদুর রাজ্জাক। সম্প্রতি তিনি বলেছেন মার্কেটে সাপ্লাই অ্যান্ড ডিমান্ডের (সরবরাহ ও চাহিদা) ওপর ভিত্তি করে এসব পণ্যের দাম ঠিক হয়। এটাই হলো ইকোনমিকসের বেসিক থিউরি। সেনাবাহিনী দিয়ে, মিগ ফিট করে কিছু করা সম্ভব না। দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি বলেও জানান কৃষিমন্ত্রী।
এদিকে, শুরু থেকে দাম বাড়ানোর অযুহাত হিসেবে বারবার বলা হচ্ছে বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির কথা। বিশ্ববাজারে সামান্য দাম বাড়ার খবর আসতে না আসতেই দেশের বাজারে দাম বাড়িয়ে দেয়া হয় কয়েকগুন। শুধু তাই নয়, যে পণ্য এখনো আমদানি করাই হয়নি সেটার হালনাগাদ দামকে বিবেচনায় নিয়েও বাড়িয়ে দেয়া হয় দাম। তবে বিশ্ববাজারে দরপতন ঘটলে স্থানীয় বিক্রেতাদের যুক্তি উল্টে যায়। তখন বলা হয় বাজারে এখন যেসব পন্য আছে সবগুলোই আগে আমদানিকৃত বা মজুদকৃত। যখন এসব আমদানি করা হয়েছিল, সেগুলোর দাম বেশি ছিল।
অন্যদিকে, আমদানির পর পাইকারী বাজার হয়ে খুচরা বাজারে পণ্য আসতে পার হতে হয় একাধিক স্তর। দোকান ভাড়া ও পরিবহন ব্যয় হিসেবে করে নির্ধারিত হয় দাম। এর বাইরেও রয়েছে অদৃশ্য খরচ। যা দাম বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এসবের মধ্যে রয়েছে চাঁদাবাজি। অভিযোগ রয়েছে এর ভাগ যায় এক শ্রেণীর অসাধূ পুলিশ, মাস্তান ও রাজনৈতিক নেতার পকেটে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ভোক্তার ওপর। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসবের লাগাম টানা গেলে কিছুটা হলেও দাম কমানো যেতো।
তবে এর আগে সিলিন্ডারের এলপিজির দাম সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু বেশিরভাগ স্থানে অতিরিক্ত দাম নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ট্যারিফ কমিশন বলছে, বাজারে কোন পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হলে ক্রেতারা সচেতন হবে, তাদের মূল্য জানা থাকবে। তখন তারা প্রতিবাদ করতে পারবেন অথবা সরকারি দপ্তরে অভিযোগ জানাতে পারবেন।
কনজ্যুমার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক বলেন, সমবায়ভিত্তিক উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই পণ্যের দামে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া সম্ভব। কৃষকপর্যায়ে যদি ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা যায়, তবে উৎপাদন বাড়বে। এতে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।