ঢাকা | রবিবার
২৫শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশ-ভুটান বাণিজ্যের নতুন জানালা

বাংলাদেশ-ভুটান বাণিজ্যের নতুন জানালা

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের। এ সম্পর্ককে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে বিষয়টিকে ভিত্তি ধরে অর্থনৈতিক কূটনীতি বিষয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করছে দৈনিক আনন্দবাজার। আজ বাংলাদেশ-ভুটানের সম্পর্ক নিয়ে “বাংলাদেশ-ভুটান বাণিজ্যের নতুন জানালা” শীর্ষক প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হলো।

  • বাংলাদেশ-ভুটান বাণিজ্য সম্পর্ক শুরু ১৯৮০ সালে
  • সচিব পর্যায়ের সভায় ৭ দফা সিদ্ধান্ত
  • ভুটানের সাথে সড়ক যোগাযোগ চালু হলে উভয়েই ব্যবসা-বাণিজ্যে লাভবান হবে-বাণিজ্যমন্ত্রী

বাংলাদেশের ১০০ পণ্য ভুটানের বাজারে এবং ভুটানের ৩৪ পণ্য বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছে। বাণিজ্যচুক্তিটি চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়নে উভয় দেশ প্রয়োজনীয় স্টেটোটরি রেগুলেটরি অর্ডার (এসআরও) জারি করেছে। চুক্তিটির ফলে উভয় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এখন থেকে আরো সহজ ও আশাদায়ক হবে। 

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল ভুটানের রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক। তবে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক শুরু হয় আশির দশকে। ১৯৮০ সালে দেশদুটি বাণিজ্য উন্নয়নের পদক্ষেপ হিসেবে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। সেখানে একে অপরকে ‘সর্বাধিক সহায়তাপ্রাপ্ত জাতি’ হিসেবে উল্লেখ করে। 

তারই আলোকে ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে ভুটান থেকে বাংলাদেশের মোট আমদানি ২৫ মিলিয়ন ছিল, একই সময়ে ভুটানে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশটির রাজধানী থিম্ফুতে আনুষ্ঠানিক সফরের সময় এই চুক্তিটি নবায়ন করা হয়। ২০১৪ সালে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে ঢাকায় সফরকালে বাংলাদেশ ভুটান থেকে ৯০ পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করে। ২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ভুটানের সাথে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের ১০০ পণ্য ভুটানে এবং ভুটানের ৩৪ পণ্য বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যা চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ভুটানের সঙ্গে এই চুক্তিটির ফলে দেশে বিনিয়োগ রফতানি আয় ও কর্মসংস্থান বাড়বে বলে আশা খাতসংশ্লিষ্টদের। এটি কোন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় প্রথম বাণিজ্যচুক্তি।

বাংলাদেশ ২০১০ সাল থেকে ভুটানকে ১৮ পণ্যে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিচ্ছে। আর বাংলাদেশের ১০ পণ্য ভুটানে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পেয়ে আসছিল। ভুটান আরও কিছু পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা চাওয়ায় দুই দেশের মধ্যে ‘দ্বিপক্ষীয় অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যচুক্তি’ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ২০১৯ সালের ১২-১৫ এপ্রিল ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় এ নিয়ে আলোচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সে বছরের ২১-২৩ আগস্ট দুই দেশের মধ্যে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একটি বৈঠক হয়। সেই আলোকে গত সেপ্টেম্বরে বাণিজ্যচুক্তির খসড়ায় অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হয়েছিল মাত্র ১২ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরমধ্যে আমদানিই ছিল বেশি। ১২ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। আর রফতানি ছিল মাত্র ০ দশমিক ৬১ মিলিয়ন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৭ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আমদানি ছিল ৪৯ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলার। বেড়েছে চারগুণ। আর রফতানি হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ডলার। বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১২ গুণ। পিটিএ সই হওয়ার ফলে বর্তমানে বাণিজ্য, পর্যটন জলবিদ্যুৎ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, স্বাস্থ্য জীববৈচিত্র্য, কৃষি আইসিটি, শিক্ষা, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ অনেক ক্ষেত্রেই এই সম্পর্ক বিস্তৃত। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভুটানকে বাংলাদেশের তিনটি সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বন্দর সুবিধা না থাকা দেশটির আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে এটি অনেক বেশি সাশ্রয়ী হবে। লালমনিরহাট পর্যন্ত নৌপথ সংস্কারকাজ সম্পন্ন হলে ভুটানের জন্য তা হবে আরও বেশি লাভজনক। বাংলাদেশও তা থেকে লাভবান হবে। ত্রিদেশীয় যৌথ উদ্যোগে ভুটানে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালকে নিয়ে গড়ে ওঠা উপ-আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা-ও এই অঞ্চলের দেশগুলোকে আরও কাছে টানবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় বাংলাদেশ সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন দেশটির অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব দেব দাশো কর্মা শেরিনের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল। এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, বাংলাদেশ ভুটানসহ প্রতিবেশি দেশের সাথে আকাশপথে যোগাযোগ স্থাপন করতে দেশের সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আঞ্চলিক বিমানবন্দর হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিমানবন্দরটির প্রয়োজনীয় উন্নয়নের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। তৃতীয় দেশের মধ্যদিয়ে ভুটানের সাথে সড়ক যোগাযোগ চালুর ফলে উভয় দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পর্যটনখাতে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হবে।

তিনি বলেন, সৈয়দপুর আঞ্চলিক বিমান বন্দর-বাংলাবান্ধা-বুড়িমারি এই তিনটি বন্দর দিয়ে বাণিজ্য ও যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ উভয় দেশের জন্য লাভজনক হবে। বাংলাদেশে চার্টার্ড এ্যাকাউনটেন্ট বিষয়ে পড়ালেখার সুযোগ নিতে পারে ভুটান। বাংলাদেশে এ বিষয়ে উন্নতমানের শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ-ভুটান বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে উভয় দেশের নতুন যুগের সূচনা হয়েছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, গত ২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভুটান অগ্রাধিতারমূলক বাণিজ্যচুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। বিগত ১ জুলাই উভয় দেশ প্রয়োজনীয় এসআরও জারি করেছে। এ চুক্তির ফলে ভুটানের ৩৪টি পণ্য বাংলাদেশের বাজারে এবং বাংলাদেশের ১০০টি পণ্য ভুটানের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের মধ্যে প্রত্যাশিত হারে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে।

ঢাকায় গত ১৩-১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ-ভুটান সচিব পর্যায়ের ৮ম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলাদেশ পক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ এবং ভুটানের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব দেব দাশো কর্মা শেরিন নিজ দেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন। সভায় ২০১৯ সালের ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি ভুটানে বাণিজ্যসচিব পর্যায়ের ৭ম সভার সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে সন্তোষ প্রকাশ করেন উভয় দলনেতা। সচিব পর্যায়ের নবম সভাটি ভুটানে অনুষ্ঠিত হবে।

বাণিজ্য চুক্তি বাস্তবায়নে উভয় দেশের মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক আলোচ্য বিষয়গুলো হলো-

১.       বাংলাদেশ-ভুটান ট্রানজিট এগ্রিমেন্ট ও প্রটোকল চূড়ান্তকরণ।

২.       বাংলাদেশ-ভুটান ট্রানজিট এগ্রিমেন্ট এবং প্রটোকলের বাস্তবায়ন সংক্রান্ত আলোচনা, বিশেষ করে তৃতীয় দেশের মধ্যদিয়ে যোগাযোগ সহযোগিতা এবং বাণিজ্য সহজিকরণ সংশ্লিষ্ট উদ্যোগসমূহ।

৩.       দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা  বিভিন্ন আঞ্চলিক ফোরামে পারস্পরিক সমর্থন।

৪.       পর্যটনশিল্পের বিকাশে উভয় দেশের পারস্পরিক সমর্থন।

৫.       কৃষি ও শিল্পখাতে উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যথাক্রমে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্স এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন বিএসটিআই, ভুটান স্ট্যান্ডার্স ব্যুরো-বিএসবি এবং ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার ইক্সটেনশন-ডিএই ও ভুটান এগ্রিকালচার এন্ড ফুড রেগুলেটরি অথরিটি-বাফরা ভুটানের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি।

৬.       বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূরীকরণে উভয় দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা। ৭.       ভুটান হতে পাথর আমদানি এবং সোনারহাট শুল্ক বন্দরের মাধ্যমে ভুটানের পণ্য পরিবহন।

সংবাদটি শেয়ার করুন